সূরা কুরাইশের সংক্ষিপ্ত তাফসীর

 অর্থ ও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে সূরা কুরাইশ পূর্ববর্তী সূরা ফীলের সাথে সম্পৃক্ত। আগের সূরাতে (সূরা ফীলে) আল্লাহ কাবাঘর ধ্বংস করার পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দেয়ার বর্ননা দিয়েছেন। তার একটি কারন ছিলো কুরাইশদের নিরাপত্তা। সূরা কুরাইশে আল্লাহ তাদের প্রতি এই নিয়ামতের কথা স্মরন করিয়ে দেন। এই নিয়ামতের প্রতিদান স্বরূপ এই ঘরের রবের ইবাদাত করা উচিত বলে আদেশ দেন। কেননা তিনি তাদেরকে ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং যুদ্ধভীতি থেকে নিরাপদ করেছেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রপিতামহ কুসাই ইবনে কিলাবের সময় পর্যন্ত কুরাইশ গোত্রে হিজাযে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বসবাস করছিল। কুসাই সর্বপ্রথম তাদেরকে মক্কায় একত্র করে। এভাবে বাইতুল্লাহর মুতাওয়াল্লীর দায়িত্ব তাদের হাতে আসে। এ জন্য কুসাইকে “মুজাম্মে” বা একত্রকারী উপাধি দান করা হয়। উনি নিজের উন্নত পর্যায়ের বুদ্ধিবৃত্তিক কুশলতা ও ব্যবস্থাপনার সাহায্যে মক্কায় একটি নগর রাষ্ট্রের বুনিয়াদ স্থাপন করেন। আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত হাজীদের খেদমতের উত্তম ব্যবস্থা করেন। এর ফলে ধীরে ধীরে আরবের সকল গোত্রের মধ্যে এবং সমস্ত এলাকায় কুরাইশদের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। 

কুসাইয়ের পর উনার পুত্র আবদে মান্নাফ ও আদুদদারের মধ্যে মক্কা রাষ্ট্রের শাসন কর্তৃত্ব বিভক্ত হয়ে যায়। কিন্তু দুই ভাইয়ের মধ্যে পিতার আমলেই আবদে মান্নাফ অধিকতর খ্যাতি লাভ করেন এবং সমগ্র আরবে উনার মর্যাদা স্বীকৃতি লাভ করতে থাকে। আবদে মান্নাফের ছিল চার ছেলে: হাশেম, আবদে শামস, মুত্তালিব ও নওফাল। এদের মধ্যে থেকে আবদুল মুত্তালিবের পিতা ও রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রপিতামহ হাশেমের মনে সর্বপ্রথম আরবের পথে প্রাচ্য এলাকার দেশসমূহ এবং সিরিয়া ও মিসরের মধ্যে যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চলতো তাতে অংশগ্রহণ করার এবং এই সংগে আরববাসীদের জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও কিনে আনার চিন্তা জাগে। উনার ধারণামতে এভাবে বাণিজ্য পথের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গোত্ররা তাদের কাছে থেকে দ্রব্য সামগ্রী কিনবে এবং মক্কার বাজারসমূহে দেশের অভ্যন্তরের ব্যবসায়ীরা সামগ্রী কেনার জন্য ভিড় জমাবে। 

এটা এমন এক সময়ের কথা যখন উত্তরাঞ্চলের দেশসমূহ ও পারস্য উপসাগরের পথে রোম সম্রাজ্য ও প্রাচ্য দেশসমূহের মধ্যে যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চলতো তার ওপর ইরানের সাসানীয় সম্রাটরা পুরোপুরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এ কারণে দক্ষিণ আরব থেকে লোহিত সাগরের উপকূল ঘেঁসে সিরিয়া ও মিসরের দিকে প্রসারিত বাণিজ্য পথে ব্যবসা বিপুলভাবে জমে উঠেছিল। আরবের অন্যান্য বাণিজ্য কাফেলার তুলনায় কুরাইশদের বাড়তি সুবিধা ছিল। কাবার খাদেম হবার কারণে পথের সমস্ত গোত্র তাদেরকে মর্যাদার চোখে দেখতো। হজ্জের সময় কুরাইশ বংশীয় লোকেরা যে আন্তরিকতা, উদারতা ও বদান্যতা সহকারে হাজীদের খেদমত করতো সে জন্য সবাই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। কাজেই কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার ওপর ডাকাতদের আক্রমণ হবে এ আশংকা ছিল না। পথের বিভিন্ন গোত্র অন্যান্য বানিজ্য কাফেলার কাছ থেকে যে বিপুল পরিমাণ পথকর আদায় করতো তাও তাদের কাছ থেকে আদায় করতে পারতো না। এসব দিক বিবেচনা করে হাশেম একটি বাণিজ্য পরিকল্পনা তৈরি করেন এবং এই পরিকল্পনায় উনার অন্য তিন ভাইকেও শামিল করেন। এভাবে উনাদের ব্যবসা দ্রুত উন্নতি লাভ করতে থাকে। আরবের কোন গোত্রে কুরাইশদরে মতো এত বেশী লেখাপড়া জানা লোক ছিল না।

এমন সময় আবরাহার মক্কা আক্রমণের ঘটনা ঘটে। যদি সে সময় আবরাহার কারনে কা’বা শরীফের মর্যাদা খতম হয়ে যেতো। এ ঘরের খাদেম হিসেবে কুরাইশদের যে মর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল তাও মুহূর্তের মধ্যে ধূলিসাৎ হয়ে যেতো। হাবশীদের মক্কা দখল করার পর রোম সম্রাট সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে সিরিয়া ও মক্কার মাঝখানের বাণিজ্য পথও দখল করে নিতো। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর অসীম কুদরতে পক্ষীবাহিনী দিয়ে পাথর মেরে আবরাহার বিশাল বাহিনীকে ধবংস করে দেন। এ সময় কা’বা শরীফের আল্লাহর ঘর হবার ব্যাপারে সমস্ত আরববাসীর ঈমান আগের চাইতেও আরো কয়েকগুণ বেশী মজবুত হয়ে যায়। এই সংগে কুরাইশিদের প্রতিপত্তিও আগের চাইতে আরো অনেক বেশী প্রতিষ্ঠিত হয়। আরবদের মনে বিশ্বাস জন্মে, এদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ বর্ষিত হয়েছে। ফলে এরা নির্বিঘ্ন আরবের যে কোন অংশে যেতো এবং নিজেদের বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে যে কোন এলাকা অতিক্রম করতো। 

আসুন সূরা কুরাইশের অর্থ জেনে নেই-

(১) لِإِيلَافِ قُرَيْشٍ

“লিঈলা-ফি ক্বুর্ইশিন্‌” 

 ‘কুরাইশের আসক্তির কারনে’ 

সূরা ফীলের সাথে অর্থগত সম্পর্কের কারণে কেউ কেউ বলেন যে, এখানে উহ্য বাক্য হচ্ছে –  আমি হস্তীবাহিনীকে এজন্যে ধ্বংস করেছি, যাতে কুরাইশদের সফরের পথে কোন বাধাবিপত্তি না থাকে। কেউ কেউ আবার এটাও বলেছেন যে, এখানে উহ্য বাক্য হচ্ছে –  তোমরা কুরাইশদের ব্যাপারে আশ্চর্যবোধ কর, তারা কিভাবে শীত ও গ্রীষ্মের সফর নিরাপদে নির্বিবাদে করে।

(২) إِيلَافِهِمْ رِحْلَةَ الشِّتَاءِ وَالصَّيْفِ

“ঈলা-ফিহিম্‌ রিহ্‌লাতাশ্‌ শিতা-য়ি অছ্‌ছোয়াইফ্‌” 

(অর্থাৎ) ‘শীতের ও গ্রীষ্মের সফরে অভ্যস্ত’ 

সিরিয়া ছিল ঠাণ্ডা দেশ। তাই কুরাইশরা গ্রীষ্মকালে সিরিয়া সফর করত। পক্ষান্তরে ইয়ামেন গরম দেশ ছিল বিধায় তারা শীতকালে সেখানে বানিজ্যিক সফর করত এবং মুনাফা অর্জন করত। এ দু’টি সফরের উপরই তাদের জীবিকা নির্ভরশীল ছিল। তারা যেহেতু কাবার তত্ত্বাবধায়ক ছিলো তাই কোন অন্য গোত্র বা দল তাদের নিরাপত্তায় কোন বাঁধা হয়ে দাঁড়াতো না। আল্লাহ্‌ তায়ালা তাদের শত্রু হস্তীবাহিনীকে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দিয়ে মানুষের অন্তরে তাদের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। তাই তারা যে কোন দেশে গমন করতো, সকলেই তাদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতো। 

(৩) فَلْيَعْبُدُوا رَبَّ هَٰذَا الْبَيْتِ

“ফাল্‌ইয়া’বুদু রব্বাহা-যাল্‌ বাইতি”  ‘অতএব তারা যেন এবাদত করে এই ঘরের পালনকর্তার’

এই নেয়ামতের ফলশ্রুতিতে কুরাইশদের কৃতজ্ঞ হওয়া ও আল্লাহ্‌ তায়ালার এবাদতে আত্মনিয়োগ করা উচিত বলে আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন। কারন তৎকালীন কুরাইশরা এক আল্লাহর উপাসনা না করে আরো অনেক কিছুর উপাসনা করতো। আল্লাহর দাসত্ব না করে নিজের নাফস ও অন্য কিছুর দাসত্বও করতো। এই গৃহই যেহেতু তাদের সব শ্রেষ্ঠত্ব ও কল্যাণের উৎস ছিল, তাই তারা যেন এই গৃহের মালিকের এবাদত করে- সেই আদেশ দেয়া হয়েছে। 

 (৪) الَّذِي أَطْعَمَهُم مِّن جُوعٍ وَآمَنَهُم مِّنْ خَوْفٍ

“আল্লাযী আত্ব’আমাহুম্‌ মিন্‌ জ্বূইঁও ওয়া আ-মানাহুম্‌ মিন্‌ খাওফ্‌” 

 ‘যিনি তাদেরকে ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং যুদ্ধভীতি থেকে তাদেরকে নিরাপদ করেছেন’ 

কাবা ঘরের তত্ত্বাবধায়ক হওয়ায় ও নিরাপত্তা সহকারে সফর ও ব্যবসা করার কারনে তাদের ক্ষুধা বা খাদ্যের সমস্যা কিংবা দস্যু ও শত্রুদের থেকে নিরাপত্তার চিন্তা ছিলো না। এভাবে আল্লাহ কুরাইশদের প্রতি তার বিশেষ দুটি নেয়ামতের কথা এখানে স্মরণ করিয়েছেন।

সারকথা:-

ছোট্ট এ সূরাটিতে চারটি বাক্যের মধ্য দিয়ে কুরাইশদেরকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যখন তোমরা নিজেরাই এ ঘরটিকে ( কা’বা ঘর) দেবমূর্তির মন্দির নয় বরং আল্লাহর ঘর বলে মনে করো। এবং যখন তোমরা ভালোভাবেই জানো যে, আল্লাহই তোমাদেরকে এ ঘরের বদৌলতে শান্তি ও নিরাপত্তা দান করেছেন। তোমাদের ব্যবসায় উন্নতি দান করেছেন। এবং অভাব অনাহার থেকে রক্ষা করে তোমাদেরকে সমৃদ্ধি দান করেছেন। তখন তোমাদের তো আসলে একমাত্র এই ঘরের মালিকেরই ইবাদাত করা উচিত।







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম