সূরা ফীলের সংক্ষিপ্ত তাফসীর

 ছোটবেলা থেকেই পড়ে আসছি সূরা ফীলের ঘটনা। হাতিবাহিনী নিয়ে কা‘বাগৃহ ধ্বংস করার জন্য আবরাহার অভিযানের ঘটনা। ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট ছোট পাখি দিয়ে (যদিও আমরা এই পাখিকে ভুল করে আবাবীল বলে থাকি) কংকর নিক্ষেপ করে হাতিবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করার ঘটনা। 

কিন্তু পুরো ঘটনাটি জানলে। সত্যিই আশ্চর্যান্বিত হয়ে যাবেন। ঘটনাটি শুনুন:-

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মের ৫০ বা ৫৫ দিন পূর্বে। ইয়ামেনের খ্রিষ্টান গভর্ণর আবরাহা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হস্তীবাহিনীসহ বিশাল সৈন্যদল নিয়ে কা‘বাগৃহ ধ্বংস করার জন্য এসেছিলো। আবরাহা ছিল বেঁটে ও দুর্বল। ফলে ইতিপূর্বে এক লড়াইয়ের সময়। আবরাহার প্রতিপক্ষ আরিয়াত্বের তরবারির আঘাতে তার নাক-মুখ কেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়। এ অবস্থায় আবরাহার গোলাম আতাওদাহ হামলা চালিয়ে আরিয়াত্বকে হত্যা করে। আবরাহা আহত অবস্থায় ফিরে আসেন। পরে সুস্থ হয়ে ইয়ামেনের একচ্ছত্র শাসক হন। যুদ্ধে নাক-মুখ কাটা হওয়ার কারণেই তাকে ‘আশরাম’ বলা হতে থাকে। তখন থেকে ‘নাককাটা আবরাহা’ নামে তিনি পরিচিত হন। আবরাহার পুরো নাম ছিল আবরাহা ইবনুছ ছাববাহ।

আবরাহা চিন্তা করলেন যে। আরবদেরকে মক্কায় হজ্জ বাদ দিয়ে ইয়েমেনের গীর্জায় হজ্জ করাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র ঘোষণা জারি করলেন যে, এবছর থেকে হজ্জ কা‘বাগৃহের বদলে ইয়েমেনের গীর্জায় হবে। তার এই ঘোষণা সর্বত্র দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল। কুরায়েশরা রাগে ফেটে পড়ল। কথিত আছে যে, তাঁদের কেউ একজন এসে ঐ জাঁকজমকপূর্ণ ‘কুল্লাইস’ গীর্জায় গোপনে ঢুকে পায়খানা করে যায়। অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, কুরায়েশদের একদল যুবক ঐ গীর্জায় ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয়। যাতে গীর্জা পুড়ে ধূলিসাৎ হয়ে যায় (ইবনে কাসীর)।

এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আবরাহা বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করেন। কোন বর্ণনায় ২০ হাজার। কোন বর্ণনায় ৬০ হাজার সৈন্যের কথা এসেছে। তাদের পরিকল্পনা ছিল। লোহার শিকলের এক প্রান্ত কা‘বার দেওয়ালে বেঁধে অন্য প্রান্ত হাতির ঘাড়ে বাঁধা হবে। অতঃপর হাতিকে হাঁকিয়ে দেয়া হবে। যাতে পুরা কা‘বাগৃহ এক সাথে উপড়ে ভেঙ্গে পড়ে (ইবনে কাসীর)।

আবরাহার কা‘বা অভিযানের খবর শুনে সর্বত্র আতংক ছড়িয়ে পড়ল। কিছু সাহসী মানুষ তাকে প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুতি নিল। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইয়ামেনের সাবেক শাসক বংশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা “যূ-নফর”। তিনি তার নিজ সম্প্রদায় এবং সমস্ত আরব জনগণকে বায়তুল্লাহ রক্ষার পবিত্র জিহাদে তার সাথে শরীক হওয়ার আহবান জানান। ফলে বহু লোক তার পতাকাতলে সমবেত হয়। এবং আবরাহার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু অবশেষে তারা পরাজিত হয়। “যূ-নফর” বন্দী হলেন। কিন্তু আবরাহা তাকে হত্যা না করে সঙ্গে নিলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর খাশ‘আম এলাকা অতিক্রমের সময় ‘নুফায়েল বিন হাবীব আল-খাশ‘আমী’ তার সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে বাঁধা দিলেন। কিন্তু তুমুল যুদ্ধের পর তারাও পরাজিত হল। নুফায়েলকে হত্যা না করে আবরাহা তাকেও সাথে নিলেন পথপ্রদর্শক হিসাবে। 

অতঃপর ত্বায়েফ অতিক্রম করার সময় সেখানকার প্রসিদ্ধ ছাক্বীফ গোত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলল। কিন্তু সেটা বায়তুল্লাহর স্বার্থে ছিল না। বরং তাদের ‘লাত’ প্রতিমা রক্ষার স্বার্থে ছিল। কারণ তারা ভেবেছিল যে। আবরাহা তাদের মূর্তি ধ্বংস করার জন্য আসছেন। পরে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারল। আবরাহার সম্মানার্থে একজন দক্ষ পথপ্রদর্শক হিসাবে ‘আবু রিগাল’ নামক জনৈক ব্যক্তিকে আবরাহার সাথে পাঠালো। তার নির্দেশনা অনুযায়ী আবরাহা মক্কার অদূরবর্তী ‘মুগাম্মিস’ নামক স্থানে অবতরণ করলেন। অতঃপর তার বাহিনী মক্কার উট-দুম্বা ইত্যাদি গবাদিপশু লুট করা শুরু করল। যার মধ্যে মক্কার নেতা আব্দুল মুত্ত্বালিবের দুশো উট ছিল।

আল্লাহর ইচ্ছায় আবরাহার পথপ্রদর্শক আবু রিগাল মুগাম্মিসে অবতরণ করেই মৃত্যুবরণ করল। সেই থেকে আরবরা তার কবরে পাথর ছুঁড়ে মারে। 

অতঃপর আবরাহা ‘হুনাত্বাহ আল-হিমইয়ারী’ নামক এক ব্যক্তিকে তার প্রতিনিধি হিসাবে মক্কায় পাঠান। এই কথা বলে যে, তিনি যেন মক্কার নেতাকে গিয়ে বলেন যে। আমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসিনি। আমরা এসেছি কা‘বাগৃহ ধ্বংস করতে। যদি তারা বাঁধা না দেন। তাহলে তাদের নেতা যেন তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। হুনাত্বাহ গিয়ে মক্কার নেতা আব্দুল মুত্ত্বালিবকে সব কথা খুলে বললেন। জওয়াবে আব্দুল মুত্ত্বালিব বললেন, আবরাহার বিশাল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এটি আল্লাহর ঘর ও তার বন্ধু ইবরাহীমের ঘর। আল্লাহ তার গৃহের হেফাযত করবেন। 

অতঃপর তিনি তার কয়েকজন পুত্রসহ আবরাহার কাছে গেলেন। আব্দুল মুত্ত্বালিবের সুশ্রী, সুঠাম, সৌম্যকান্তি দেখে আবরাহা শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে। তার আসন থেকে নেমে এসে তার পাশে বিছানায় বসেন। পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদা বজায় রেখে দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলেন। আব্দুল মুত্ত্বালিব তাঁর লুট করা দুশো উট ফেরত চাইলেন। কিন্তু কা‘বাগৃহ সম্পর্কে কিছু বললেন না। এতে বিস্মিত হয়ে আবরাহা বললেন, ‘আপনাকে দেখে আমি শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমি বিস্মিত হচ্ছি এজন্য যে, আপনি কেবল আপনার স্বার্থের কথা বললেন। অথচ যে কা‘বাগৃহ আমরা ধ্বংস করতে এসেছি। যা আপনার ও আপনার পিতৃপুরুষের ইবাদতগৃহ। তার সম্পর্কে আপনি কিছুই বললেন না’। 

তখন জবাবে আব্দুল মুত্ত্বালিব বললেন, ‘আমি মালিক উটের। আর ঐ গৃহের একজন মালিক আছেন। যিনি তাকে রক্ষা করবেন’ (তানতাভী)। আবরাহা বললেন, ‘আজ আমার হাত থেকে কাবাকে রক্ষা করার কেউ নেই’। আবদুল মুত্ত্বালিব বললেন, ‘এটা আপনার ও তাঁর (অর্থাৎ আল্লাহর) ব্যাপার’।

আবদুল মুত্ত্বালিব তাঁর দুশো উট নিয়ে ফিরে এলেন। অতঃপর সবাইকে মক্কা থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নিতে বললেন। তারপর তিনি নিজে ও একদল সাথীসহ গিয়ে কা‘বাগৃহের দরজার চৌকাঠ ধরে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকলেন। কাঁদতে থাকলেন।

অতঃপর আবরাহা যখন মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার উদ্যোগ নেন। হাতিকে মক্কার দিকে হাঁকাতে চেষ্টা করেন, তখন হাতি বসে পড়ে। অতঃপর শত চেষ্টা করেও হাতিকে মক্কা মুখী করা যায়নি। অথচ ইয়ামেন মুখী করা হলেই কেবল হাতি দৌড় দেয়। মক্কা মুখী করলেই সে বসে পড়ে।

ইতিমধ্যে সাগরের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অচেনা পাখি আসতে শুরু করে। যাদের প্রত্যেকের মুখে একটি ও দু’পায়ে দু’টি করে কংকর ছিল। যা ডাল ও গমের মত সাইজের। এই কংকর যার মাথায় পড়েছে। সে ধ্বংস হয়েছে। সবাইকে লাগেনি। কিছু আঘাতপ্রাপ্তদের মরতে দেখে বাকী সবাই দিগ্বিদিক ছুটে পালাতে শুরু করে।

আবরাহা বাহিনী মক্কা থেকে পালিয়ে ইয়ামেন পর্যন্ত পথে পথে মরতে মরতে যায়। আবরাহা তার প্রিয় রাজধানী ছান‘আ শহরে পৌঁছে লোকদের কাছে আল্লাহর গযবের ঘটনা বলার পর মৃত্যুবরণ করে। এ সময় তার বুক ফেটে কলিজা বেরিয়ে যায়। ইবনু ইসহাক বলেন, এর পরপরই আল্লাহ তাঁর বিশেষ রহমত স্বরূপ কুরায়েশদের গৃহে তাঁর প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করেন। এই ঘটনার পর দশ বছর মক্কার লোকেরা মূর্তিপূজা থেকে বিরত থাকে।

এবার সূরাটি পড়ে নেই:-

أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ

(১) আলাম তারা কাইফা ফা'আলা রাব্বুকা বিআছহ্বা-বিল ফীল ।      

তুমি কি দেখো নি, তোমার প্রভু হস্তীওয়ালাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলেন? 

أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِي تَضْلِيلٍ

(২) আলাম ইয়া জ্বআ'ল কাইদা হুম ফী তাদ্বলীলিওঁ।

 তিনি কি তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেননি? 

وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيلَ

(৩) ওয়া আরসালা আ'লাইহিম ত্বইরান আবা-বীল ।       

তিনি তাদের উপরে প্রেরণ করেছিলেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। 

تَرْمِيهِمْ بِحِجَارَةٍ مِنْ سِجِّيلٍ

(৪)  তারমীহিম বিহ্বিজ্বা-রাতিম মিন সিজ্বজ্বীলিন।

 যারা তাদের উপরে নিক্ষেপ করেছিল মেটেল পাথরের কংকর।

فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَأْكُولٍ

(৫) ফাজ্বা'আলাহুম কা'আছফিম মা'কূল । 

অতঃপর তিনি তাদের করে দেন ভক্ষিত তৃণসদৃশ।

সারকথা :‌

বায়তুল্লাহর হেফাযত ও নিরাপত্তার দায়িত্ব আল্লাহর। আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত পৃথিবীর কোন শক্তি একে ধ্বংস করতে পারবে না।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম