তাকাসুর শব্দের অর্থ হলো, অধিক কামনা করা বা প্রাচুর্য নিয়ে পরস্পর প্রতিযোগিতা করা। ধন-সম্পদ, ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তি এসবের অধিক কামনা এবং প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা আমাদের ভালো মন্দ ও ন্যায় অন্যায়ের মাঝে পার্থক্যের ক্ষমতাকে বিনষ্ট করে দেয়। তখনই নেমে আসে বিপর্যয়। বৈধ পন্থা ব্যতীত অবৈধ পন্থায় সম্পদ সংগ্রহ করা, অবৈধ ক্ষমতা, ধন-সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তির পেছনে এই যে আমাদের সার্বক্ষণিক পাগলের মত ছুঁটে চলা। কিংবা বৈধ সম্পদও আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় না করা। আমাদের অসীম এই চাহিদা ও পরিতৃপ্তির যেন কোন শেষ নেই! আর এই ক্রমবর্ধমান প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা একসময় আমাদেরকে আল্লাহর হুকুম এবং আখেরাত হতে উদাসীন করে দিয়ে সোজা কবর পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছে।
এ সম্পর্কে সূরা তাকাসুরে আল্লাহ বলছেন-
১: أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ “আল হাকুমুত তাকাসুর”
অর্থ: “প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে।”
তাকাসুর কথাটির অর্থ ব্যাপক। যা টাকা পয়সা, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, সহযোগী-পৃষ্ঠপোষক, বংশ-গোত্র, ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তি প্রভৃতি শামিল। প্রত্যেক ঐ বস্তু যার প্রাচুর্য ও আধিক্য মানুষের প্রিয়। যা অধিকভাবে পাবার প্রচেষ্টা ও কামনা মানুষকে আল্লাহর আহকাম এবং আখেরাত হতে উদাসীন করে দেয়। সেটাই এ আয়াতের উদ্দেশ্য। এখানে আল্লাহ তাআলা মানুষের সেই দুর্বলতাকে ব্যক্ত করেছেন, যার শিকার সর্বযুগে অধিকাংশ মানুষকে হতে হয়েছে।
আল্লাহ বলেন, “আর জেনে রাখ, তোমাদের সম্পদ এবং সন্তান–সন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষা ছাড়া কিছু নয়, আর নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট রয়েছে মহা পুরস্কার (যারা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে তাদের জন্য)।” (সূরা আনফাল: ২৮)
২: حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ “হাত্তা যুরতুমুল মাকাবির”
অর্থ: “যতক্ষণ না তোমরা কবরে পৌঁছে যাও।”
এর অর্থ হল, অত্যাধিক্য ধনসম্পদ উপার্জন করার উদ্দেশ্যে পরিশ্রম করতে করতে মৃত্যু তোমাদেরকে গ্রাস করে ফেলল এবং শেষ পর্যন্ত তোমরা কবরে গিয়ে পৌঁছলে!
৩: كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُونَ “কাল লা, সাওফা তা’লামুন”
অর্থ: “কিন্তু শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে।”
অর্থাৎ সত্য হচ্ছে এই যে মৃত্যু অতি নিকটে। এই পার্থিব জীবনের বাস্তবতা তোমাদের কাছে শীঘ্রই প্রকাশিত হয়ে পড়বে।
৪: ثُمَّ کَلَّا سَوۡفَ تَعۡلَمُوۡنَ “সুম্মা কাল লা সাওফা তা’লামুন” অর্থ: “এবং অতঃপর তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে।”
এখানে আল্লাহ একই কথা পুনরাবৃত্তি করার মাধ্যমে এ ব্যাপারটিকে জোড় দিচ্ছেন যে জীবনের বাস্তবতা বুঝতে পারার এই মুহূর্তটি অতি অতি নিকটে!
৫: كَلَّا لَوْ تَعْلَمُونَ عِلْمَ الْيَقِينِ “কাল লা লাও তা’লামুনা ইলমাল ইয়াকিন।”
অর্থ: “যদি তোমরা নিশ্চিতভাবে জানতে!”
আমাদের যদি এই নিশ্চিত জ্ঞান থাকত, তাহলে এই জীবন পরীক্ষার বিষয় হত না। যদি মুমিনদেরকে নিশ্চিত জ্ঞান দেয়া হত, তবে তারা কখনও পথভ্রষ্ট হত না। তারা ফেরেশতায় পরিণত হত। কিন্তু আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করতে চান। বুখারী শরীফের হাদীসে আছে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “আমি যা জানি, তা যদি তোমরা জানতে, তবে তোমরা অল্পই হাসতে এবং অধিক ক্রন্দন করতে।”
৬: لَتَرَوُنَّ الْجَحِيمَ “লা তারাউন্নাল জাহিম।”
অর্থ: “তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম দেখতে পাবে।”
আমরা প্রত্যেকেই জাহান্নামের আগুন প্রত্যক্ষ করব। তবে এই জীবনে নয়, মৃত্যুর পরের জীবনে। আল্লাহ সূরা মারইয়ামে উল্লেখ করছেন:
“তোমাদের মাঝে এমন কেউ নেই, যাকে এর (জাহান্নামের আগুনের) নিকটে আনা হবে না…” (সূরা মারইয়াম : ৭১)
৭: ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيْنَ الْيَقِينِ “সুম্মা লাতারাউন্নাহা আইনাল ইয়াকীন।”
অর্থ: “অতঃপর নিশ্চয়ই তোমরা একে (জাহান্নাম) স্বচক্ষে দেখবে।”
মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে আমরা জাহান্নাম স্বচক্ষে দেখতে পারব। আমরা একে নিশ্চিতভাবে দেখব: “আইনুল ইয়াকীন”। রাসূলুল্লাহ (সা) ব্যাখ্যা করেছেন, মুমিনগণ যখন জাহান্নামের আগুন দেখবে, তারা তা দেখে উৎফুল্ল হবে, কেননা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাদেরকে এ থেকে বাঁচিয়েছেন। তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়বে। কিন্তু অবিশ্বাসীদের এ দৃশ্য দেখানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের কষ্ট বৃদ্ধি করা। এ দৃশ্য দেখে তারা চরম দুঃখ, ক্ষোভ (নিজেদের মূর্খতার কারণে), হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে, একথা উপলব্ধি করে যে তাদেরকে এখানে থাকতে হবে চিরকাল!
৮: ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ “সুম্মা লাতুসআলুন্না ইয়াওমাইযিন আনইন্নাইম।” অর্থ: “অতঃপর সেদিন তোমরা অবশ্যই (পার্থিব) আনন্দ–উপভোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”
কিয়ামতে এই জিজ্ঞাসা ঐ সকল নিয়ামত (সুখ-সম্পদ) সম্পর্কে হবে, যা দুনিয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে দান করে থাকেন। যেমন, চোখ, কান, হৃদয়, মস্তিষ্ক, শান্তি, সুস্থতা, মাল-ধন ও সন্তান-সন্ততি ইত্যাদি। কোন কোন উলামাগণ বলেন, এই জিজ্ঞাসা কেবলমাত্র কাফেরদেরকেই করা হবে। আবার কেউ কেউ বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তিকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হবে। কেননা, শুধুমাত্র জিজ্ঞাসা করা আযাবের জন্য জরুরী নয়। বরং যারা এ সব নিয়ামতকে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী ব্যবহার করবে, তাকে প্রশ্ন করা সত্ত্বেও আযাব থেকে নিরাপদে রাখা হবে। আর যারা আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করবে, তারা আযাবে পতিত হবে।