বাংলার অতি প্রাচীন বচন "সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে"। অর্থাৎ আপনার বন্ধু যেমন হবে তার সঙ্গে থাকলে তার গুণাগুণ আপনার মধ্যে চলে আসবে। তাই জীবনে ভাল বন্ধুর গুরুত্ব অপরিসীম। আজকে ইসলামের আলোকে লেখার চেষ্টা করব বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইসলাম আমাদের কি নির্দেশনা দেয়।
প্রথমতঃ কারো সাথে বন্ধুত্ব বা শত্রুতা হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য। নিজের দুনিয়াবি খেয়াল-খুশি বা খাহেশাত পূরণের জন্য কারো সাথে বন্ধুত্ব বা শত্রুতা করা যাবেনা। এমন লোকের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে যাকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণে আসে, আখেরাতের কথা মনে আসে।
হযরত ইমাম গাজ্জালী (রঃ) বলেন- কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে হলে তিনটি গুণের দিকে খেয়াল করতে হবেঃ
১। নেককার ও পুণ্যবান,
২। চরিত্রবান,
৩। জ্ঞানী ও বিচক্ষণ।
হজরত ইমাম জয়নুল আবেদিন তার ছেলেকে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে ৫ ধরণের লোককে এড়িয়ে চলতে উপদেশ দেন-
১। মিথ্যাবাদী,
২। পাপী,
৩। কৃপণ,
৪। নির্বোধ,
৫। যারা স্বজনদের সঙ্গে প্রতারণা করে।
হযরত আবু যার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন : "আমলের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট হল আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসা, আর আল্লাহর জন্যই কারো সাথে ঘৃণা ও শত্রুতা পোষণ করা।" (আবূ দাঊদ ৪৫৯৯, য‘ঈফুত তারগীব ১৭৮৬, মিশকাতুল মাসাবিহঃ ৩২)
আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ হল, কস্তুরী বহনকারী (আতরওয়ালা) ও হাপরে ফুৎকারকারী (কামারের) ন্যায়। কস্তুরী বহনকারী (আতরওয়ালা) হয়তো তোমাকে কিছু দান করবে অথবা তার কাছ থেকে তুমি কিছু খরিদ করবে অথবা তার কাছ থেকে সুবাস লাভ করবে। আর হাপরে ফুৎকারকারী (কামার) হয়ত তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে অথবা তুমি তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে।" (বুখারী ২১০১, ৫৫৩৪, মুসলিম ২৬২৮, আহমাদ ১৯১২৭, ১৯১৬৩, রিয়াদুস সলেহিনঃ ৩৬৭)
কিয়ামতের দিন অসৎ বন্ধুর জন্য আফসোস করতে হবে। সূরা ফুরকানের ২৮ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন, "জালিম সেদিন নিজের দুই হাত দংশন করতে করতে বলবে, হায় দুর্ভাগ্য, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম।"
যারা ইসলামে বিশ্বাসী না তাদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব না রাখার আদেশ কোরআনে এসেছে, এমনকি তারা যদি নিজের পিতা বা ভাইও হয়। সূড়া তওবার ২৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন, "হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজ পিতা ও ভাইদের অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ কোরো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে ভালোবাসে।"
কোরআনের অন্যত্র এসেছে, "হে ঈমানদারগণ! তোমরা মুসলমানদের বাদ দিয়ে কাফিরদের বন্ধু বানিয়ো না। তোমরা কি এমনটা করে নিজের ওপর আল্লাহর প্রকাশ্য দলিল কায়েম করে দেবে।" (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৪৪)
আবার অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব গ্রহণে ইসলাম সম্পূর্ণ নিষেধ করেছে, মূলত তারা একে অপরের বন্ধু। এই মর্মে ইরশাদ হচ্ছে, "হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ কোরো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। আর আল্লাহ জালিমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।" (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৫১)
একজন ঈমানদার যদি ঈমানদার ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, তাহলে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এই মর্মে ইরশাদ হচ্ছে, "মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফিরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।" (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ২৮)
আল্লাহর সাথে বন্ধুত্বতার ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, "মনে রেখো, যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোনো ভয়ভীতি নেই, তাদের কোনো চিন্তাও নেই।" (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৬২)
মূলত যারা আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রাখে ও রাসূল (সাঃ) এর জীবনা-আদর্শ মেনে চলে আমাদের বন্ধুত্ব করতে হবে তাদের সাথে। সূরা মায়িদার ৫৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন, "তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ ও তাঁর রাসুল এবং মুমিনগণ—যারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং বিনম্র।"
পরিশেষে আবারো বলি, বন্ধুত্ব হতে হবে আল্লাহর সন্তষ্টি ও পরকালের কল্যাণে। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেককে পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও বন্ধুত্ব লাভে কুরআন এবং হাদিসের নির্দেশনা অনুসরণ ও অনুকরণ করার তাওফিক দান করুন।
©মফিজুল ইসলাম