দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুইজনের বাড়ী নদীর দুই পারে। তার মধ্যে এক বন্ধুর পা নেই। হাটতে-চলতে পারেনা। এই বন্ধু জানতে পারছে যে নদীর ঐ পারের বন্ধু তিন ধরে না খাওয়া। তার ঘরে কোন খাবার নেই; সে তিন দিন ধরে উপোস করে আছে। তো এই পঙ্গু বন্ধু তার স্ত্রীকে বলছে- "যাও, নদীর ঐপারে আমার বন্ধুর কাছে খাবার নিয়ে যাও। সে তিন দিন ধরে উপবাস। আমার পা থাকলে আমিই নিয়ে যেতাম। যেহেতু আমি যেতে পারছিনা সেহেতু তোমাকেই যেতে হবে।" লোকটির স্ত্রী বলল যে- "যাব। কিন্ত কিভাবে যাব? নদীতে তো নৌকা নাই। এত বড় নদী, আমি খাবার নিয়ে কিভাবে পার হব? আর আমাদের এই নদীতে কোন নৌকাও নেই।"
তখন লোকটি তার স্ত্রীকে বলল, "তুমি খাবার নিয়ে নদীর ধারে যাও। নদীকে বল, আল্লাহর যে বান্দা ৪০ বছর ধরে নিজের স্ত্রীকে ব্যবহার করে নাই তার অসীলায় নদী পার করে দাও।" একথা শুনে লোকটির স্ত্রী তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করলো, এটা কি নিজের কথা বললে? লোকটি বলল, হ্যা। লোকটির স্ত্রী যারপরনাই বিস্মিত হল। ভাবলো আমি তার স্ত্রী। আমি জানি সে আমাকে ব্যবহার করেছে কিনা। আমাদের বাচ্চা-কাচ্চাও আছে। তাহলে তার স্বামী এমন বলছে কেন? আবার সে তার স্বামীকে কোনদিন মিথ্যা বলতেও শুনেনি।
বুখারী শরীফে এমন একটা ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। নদীর দুই পারে দুই বন্ধুর বাড়ী। এক বন্ধু আরেক বন্ধুর থেকে টাকা ধার নিয়েছে। ধার নেওয়ার সময় দেনাদার বন্ধু তার পাওনাদার বন্ধুর কাছে ওয়াদা করছে যে অমুক তারিখে অমুক সময়ে তোমার টাকা ফেরৎ দেব ইনশাল্লাহ।
তো নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে দেনাদার বন্ধু একজন লোক মারফৎ তার পাওনাদার বন্ধুর কাছে টাকা পাঠিয়ে দিল। খানিকপরে তার মনে হল, লোকটি যদি নির্দিষ্ট সময়ে না পৌছাতে পারে তাহলে তো তার কথার বরখেলাপ হয়ে যাবে, তারচেয়ে বরং সে নিজ হাতে টাকাগুলো পৌছে দিবে। তারপর সে ঐ লোকটির পথে গমন করলো এবং কিছুদূর গিয়ে তার দেখা পেল। দেনাদার বন্ধুটি লোকটির কাছে থাকা টাকাগুলো নিয়ে নদীর পাড়ে এলো। এসে দেখে নদীতে কোন খেয়া নাই। কিভাবে নদী পার হবে ভেবে পাচ্ছেনা। নির্দিষ্ট সময়ে টাকা না পৌছাতে পারলে কথার বরখেলাপ হয়ে যাবে এই চিন্তায় দেনাদার বন্ধুটি পেরেশান হয়ে পড়ল।
এমন সময় তার মনে পড়ল, "আল্লাহ বিশ্বাসীদের সাথে থাকেন।"
সে একটি কাঠের বাক্সে টাকাগুলো ভরলো। তারপর ভালো করে বাক্সের মুখ বন্ধ করে নদীতে ভাসিয়ে দিল। বাক্সটি ভাসতে ভাসতে নদীর ওপারে থাকা তার পাওনাদার বন্ধুর বাড়ীর দিকে যেতে লাগলো। কিতাবে আসছে, যখন বাক্সটি তার পাওনাদার বন্ধুর বাড়ীর দিকে যাচ্ছিল তখন স্রোতের গতি ছিল বিপরীত দিকে। অর্থাৎ স্রোতের উল্টো দিকে ভাসতে ভাসতে বাক্সটি পাওনাদার বন্ধুর বাড়ীর দিকে যাচ্ছিল। আল্লাহ এমনভাবেই বিশ্বাসীদের সাথে থাকেন।
মূল ঘটনায় আসা যাক। লোকটির স্ত্রী ভাবতে লাগলো বিয়ের পর থেকে সে স্বামীকে কোনদিন মিথ্যা বলতে শুনেনি, আজ কেন তার স্বামী মিথ্যা বলছে? আমাদের মিলনের ফলে বাচ্চা-কাচ্চা থাকা সত্ত্বেও তার স্বামী কেন বলছে যে ৪০ বছর ধরে নিজের স্ত্রীকে ব্যবহার করে নাই তার অসীলায় নদী পার করে দাও? যাহোক, তার স্ত্রী নদীর পাড়ে গেল এবং বলল, "আল্লাহ, তোমার যে অলী দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে নিজের স্ত্রী ব্যবহার করেনি তার উসিলায় আমাকে এই নদী পার করায়ে দেও।" এই কথা বলার সাথে সাথে নদীর পানি শক্ত হয়ে গেল। লোকটির স্ত্রী নদী পার হয়ে ঐ পারে চলে গেল। নদীর পানি আবার তরল হয়ে গেল।
আল্লাহ চাইলে বাক্সও স্রোতের উল্টো দিকে যেতে পারে, নদীর তরল পানি মুহূর্তের মধ্যে কঠিন হতে পারে। এটাতো আল্লাহর কুন-ফায়াকুনের আওতায়। আরবী كن (কুন) অর্থ হও এবং فيكون অর্থ অতঃপর হয়ে যায়। যেমন, সূরা ইয়াসীন এর ৮২ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,
اذا اراد شيئا ان يقول له كن فيكون
অর্থঃ মহান আল্লাহ পাক তিনি যখন কোন কিছু সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করেন তখন সেটাকে বলেন كن হও فيكون অতঃপর সেটা হয়ে যায়।
সূরা বাকারার ১১৭ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ সবগুলো আকাশ এবং পৃথিবীর অস্তিত্বদানকারী তিনি। যখন তিনি কিছুর অস্তিত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তিনি সেটাকে শুধু বলেন: ‘হও’, আর তা হয়ে যায়।
সূরা আল ইমরানের ৫৯ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ ঈসার উদাহরণ হলো আদমের মত, যাকে তিনি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘হও’, আর তিনি হয়ে যান।
আমরা জানি, নবি ঈসা عليه السلام একদিন হঠাৎ করে জন্ম হননি। তার মা হযরত মরিয়ম কোন পুরুষের স্পর্শ ছাড়াই তাকে গর্ভে ধারন করেছেন, দীর্ঘ প্রসব বেদনার মধ্য দিয়ে জন্ম দিয়েছেন। সেটা এতটাই ভয়ঙ্কর কষ্টের ছিল যে, তার মা যে তাকে জন্ম দেওয়ার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে, আল্লাহর تعالى কাছে মরে যেতে চেয়েছিলেন, সেটা কু’রআনেই রেকর্ড করা আছে।
প্রায় একই রকম আরেকটি ঘটনা আমাদের প্রায় সকলেরই জানা। হযরত মুসা নবী যখন ফেরাউনের তাড়া খেয়ে নীল নদের তীরে এসে পৌছাল। তখন আল্লাহর ইচ্ছায় নীল নদের পানি শক্ত হয়ে দু ভাগ হয়ে পথ তৈরী হয়ে যায়। ফলে মুসা নবী এবং তার অনুসারীরা সহজেই সেখান দিয়ে পার হয়ে যান। কিন্ত একই পথ দিয়ে যখন ফেরাউন ও তার অনুসারীরা পার হতে গেল, তখন পানি তরল হয়ে যায় ফলে ফেরাউন ও তার অনুসারীদের নীল নদে সলীল সমাধি ঘটে। এভাবে আল্লাহর উপর বিশ্বাসের ফলাফল অপরিসীম।
এখন অনেকে বলবে আমরা তো আল্লাহতে বিশ্বাস করি, তারপরও আমাদের এত সমস্যা কেন? আমার চাওয়া-পাওয়াগুলো পূর্ণতা পায়না কেন? কেন বার বার হতাশ হই? এটা নিয়ে ডিটেইলস একটা পোষ্ট দেব ইনশাল্লাহ। তবে সংক্ষেপে এখানে বলে যাই যে, আপনার চাওয়ার মধ্যে অপূর্ণতা রয়ে গেছে, অথবা আপনার রিজিক হালাল না, অথবা আপনার আমল (নামাজ, রোজা, জিকির) এর মধ্যে কমতি আছে।
যাহোক, নদী পার হয়ে লোকটির স্ত্রী গিয়ে দেখল সত্যিই তার স্বামীর বন্ধু তিন দিন ধরে না খাওয়া। পর্দার আড়াল থেকে মহিলা তাকে খাবার দিল। লোকটি খেল। তখন মহিলা জিজ্ঞেস করলো, আমি এখন ঐ নদী পার হয়ে ফিরে যাব কিভাবে? লোকটি বলল, "নদীর কাছে গিয়ে বল, হে আল্লাহ, তোমার যে অলী দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে খানা খায়নি তার উসিলায় আমাকে এই নদী পার করায়ে দেও।" মহিলা তখন তার স্বামীর কথা শুনে যতটা বিস্মিত হয়েছিল তার স্বামীর বন্ধুর কথা শুনে দ্বিগুণ বিস্মিত হয়ে গেল। মনে ভাবল লোকটা বলে কি! লোকটা আগে-পরে খানা তো খাইছেই, আমার সামনে বসেও খেল। এখন বলতেছে ৪০ বছর ধরে খানা খায়নি! কিছুক্ষণ পর মহিলার ঘোর কাটার পর তিনি নদীর দিকে রওনা দিলেন আর ভাবতে লাগলেন, এক মিথ্যা বলে তো নদী পার হয়ে এসেছি আরেক মিথ্যা বলে দেখি কি হয়!
লোকটির কথা মত মহিলা নদীর পাশে এসে একই কথা বলল, "আল্লাহ, তোমার যে অলী দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে খানা খায়নি তার উসিলায় আমাকে এই নদী পার করায়ে দেও।" সাথে সাথে নদীর পানি পুনরায় শক্ত হয়ে গেল এবং মহিলা নদী পার হয়ে বাড়ী ফিরে আসল।
বাড়ী ফিরে এসে মহিলা তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, আমি জানি তুমি কোনদিন মিথ্যা বলনি, কিন্ত আজ কেন বললে? আমি তোমার স্ত্রী, আমি জানি তুমি আমাকে ব্যবহার করেছ কিনা। কিন্ত মিথ্যা বলার কারণ কি? তুমি তো মিথ্যা বললে, তোমার বন্ধুও মিথ্যা বলল। বলল যে উনি নাকি ৪০ বছর ধরে কোন খানা খায়নি, অথচ উনি আগে তো খানা খেয়েছেই, আমার নিয়ে যাওয়া খানাও খেয়েছে। তোমাদের দুই বন্ধুর এরকম মিথ্যা বলার কারণ কি?
স্ত্রীর কথা শুনে লোকটি বলল, "আমি এবং আমার বন্ধু দু'জনের কেউই মিথ্যা বলেনি। হে আমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী, তোমাকে বিয়ে করেছি ৪০ বছর। এই ৪০ বছর একসাথে ঘর-সংসার করেছি। বাচ্চা-কাচ্চাও মানুষ করেছি। কিন্ত স্ত্রী শুনে রাখ... এগুলো আমার নিজের জন্য কিছুই করিনি। যা করেছি শুধু মাত্র আল্লাহর সন্তষ্ঠির জন্য করেছি। অনুরুপভাবে আমার বন্ধুও মিথ্যা বলেনি। আমার বন্ধু গত ৪০ বছরে যা খানা খেয়েছে, তার উদ্দেশ্য ছিল এরকম যে কোন রকমে কিছু খেয়ে শরীরটা ঠিক রাখা। যাতে করে সে ঠিক মত আল্লাহর ইবাদাত করতে পারে। সে নিজের জন্য কিন্ত কখনো খানা খায়নি।" আল্লাহু আকবার।
মুসলমানের প্রতিটা কাজই ইবাদাত। হোক সেটা বিয়ে করা, সংসার করা, খানা খাওয়া, ঘুম, ইস্তিঞ্জা (পেশাব-পায়খানা), চলা-ফেরা সবই ইবাদাত। কিন্ত তার মধ্যে একটা শর্ত থাকা আবশ্যক, নিয়্যত সঠিক থাকা চাই।
রাসূল (সাঃ) বলেন, إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ অর্থঃ আমল বা কাজের প্রতিদান নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ আমার নিয়্যত যদি এমন হয় যে, আমি বাজারে যাব। কিন্ত নিয়্যত হবে আমি কালেমার দাওয়াত দিতে যাচ্ছি, কিন্ত আসার পথে কিছু সদাই করে আনব (রান্না করে খাব এই নিয়তে বাজারে যাব না)। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি এজন্য যে পরবর্তী ওয়াক্তের নামাজ যেন সঠিক ভাবে পড়তে পারি (শরীরের ক্লান্তি দূর করার জন্য নয়)। আমি ভাত খাচ্ছি এই নিয়্যতে যে ইবাদত করার জন্য যেন যথেষ্ঠ শক্তি পাই (নিজের শরীর দীর্ঘ দিন বাচায়ে রাখব এই মনোভাবে নয়)। আমি বিয়ে করেছি রাসূলের (সাঃ) উম্মত বৃদ্ধি করার জন্য (নিজের খাহেশাত পূরণ করার জন্য নয়)। এরপর যদি আমরা গোসল ও ইস্তিঞ্জা যদি সুন্নত তরিকায় (পদ্ধতি, method) করতে পারি তাহলে সেটাও আমাদের জন্য ইবাদাত বলে গন্য হবে।
কিন্ত আশ্চর্য্যের বিষয় হল বেশিরভাগ মুসলিম তরুণ-তরুণীরা জানেনা খাওয়া, গোসল, ইস্তিঞ্জা, কথা-বার্তা, হাটা-চলা-ফেরার সুন্নত তরিকা কি! আমি একদিন নামাজ পড়ে এসে টুপি মাথায় দিয়ে ইস্তিঞ্জায় গেছি। আমার রুমমেট বলল, ভাই আপনি টুপি মাথায় দিয়ে ইস্তিঞ্জায় গেছেন কেন? আপনার তো গুনাহ হবে। ও ভাবছে টুপি একটা পবিত্র জিনিস, সেটা ইস্তিঞ্জায় নিয়ে যাওয়ার জিনিস নয়। অথচ ইস্তিঞ্জায় যাওয়ার সময় টুপি বা নিদেনপক্ষে রুমাল মাথায় রাখা সুন্নাত।
যাহোক, এই পোষ্টের বিষয় ছিল আল্লাহর উপর বিশ্বাস অটল থাকলে কত অসম্ভব জিনিস সম্ভব হতে পারে সেটা আলোচনা করা। আল্লাহ আমাদের সকলকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় চলে ইহকালে শান্তি ও পরকালে নাজাত (মুক্তি) দান করুন - আমীন।
