মানুষ সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সুন্দরতম সৃষ্টি। স্বয়ং আল্লাহ একথা শপথ করে বলছেন- তিনি মানুষকে সর্বোত্তম অবয়বে সৃষ্টি করেছেন।
কিসে মানুষের এই শ্রেষ্ঠত্ব? অতঃপর কি কারনে তার নিকৃষ্টতম পতন? এবং ক্বিয়ামত দিবসে ঈমান ও সৎকর্মের কি প্রতিদান? এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে সূরা তীনে। আসুন জেনে নেই-
(১) وَ التِّیۡنِ وَ الزَّیۡتُوۡنِ
“অত্তীনি অয্যাইতূনী”
‘ডুমুর ও যয়তূন বৃক্ষ।’
(২) وَ طُوۡرِ سِیۡنِیۡنَ ۙ
“অত্বুরি সীনীনা”
‘সিনাই প্রান্তরস্থ তূর পর্বত।’
(৩) وَ هٰذَا الۡبَلَدِ الۡاَمِیۡنِ
“অহা-যাল্ বালাদিল্ আমীন”
‘এবং এই নিরাপদ নগরীর (মক্কা) শপথ।’
এ সূরায় চারটি বস্তুর শপথ করা হয়েছে। (এক) তীন অর্থাৎ, আঞ্জীর তথা ডুমুর বৃক্ষ। (দুই) যয়তূন বৃক্ষ। (তিন) সিনাই প্রান্তরস্থ তূর পর্বত। (চার) মক্কা মোকাররমা, এই নগরীকে আল্লাহ ‘নিরাপদ’ বলে ঘোষণা করেছেন।
(৪) لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ فِیۡۤ اَحۡسَنِ تَقۡوِیۡمٍ
“লাক্বদ্ খলাক্ব্ নাল ইন্সা-না ফী আহ্সানি তাক্বওয়ীম্”
‘আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সর্বোত্তম অবয়বে’।
যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনিই জানেন সৃষ্টিসেরা কে? আল্লাহ্র সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে মানুষ অপেক্ষা সুন্দর কেউ নেই। কেননা, আল্লাহ্ তাআলা মানুষকে জ্ঞানী, মহৎ, শক্তিবান, দ্রষ্টা, কুশলী এবং প্রজ্ঞাবান করেছেন। এগুলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তাআলার অসীম গুনাবলীর কিঞ্চিততম অংশ। তাই ঈমান ও সৎকর্মশীলতার কারনেই মানুষের এই শ্রেষ্ঠত্ব সবার উপরে নির্ধারিত। কিন্তু কাফির-মুশরিক ও পাপিষ্ঠরা সর্বোত্তম হওয়া তো দূরের কথা, এরা চতুষ্পদ জন্তুর চাইতে নিকৃষ্ট। ‘এরা জ্ঞান থাকতেও বুঝে না, চোখ থাকতেও দেখেনা, কান থাকতেও শোনে না’ (আ‘রাফ ৭/১৭৯)।
এ আয়াতে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মানুষ শুরু থেকেই সুন্দর অবয়ব বিশিষ্ট মানুষ ছিল। সে কখনোই বানর বা অন্য কিছু ছিল না। বস্ত্ততঃ কুরআনী সত্যের সামনে ডারউইনের বিবর্তনবাদের কাল্পনিক থিওরী একেবারেই অচল ও অগ্রহণযোগ্য।
(৫) ثُمَّ رَدَدۡنٰهُ اَسۡفَلَ سٰفِلِیۡنَ
“ছুম্মা রদাদ্না-হু আস্ফালা সা-ফিলীন”,
‘অতঃপর তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি সর্বনিম্ন স্তরে’।
এ আয়াতের অর্থ এটাও হতে পারে যে, ‘তাকে জাহান্নামে ফিরিয়ে দিয়েছি’। অর্থাৎ সর্বোত্তম অবয়ব ও সর্বোন্নত রুচি ও মর্যাদার অধিকারী হওয়ার পরেও আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য না করার ফলে মানুষ পশুত্বের সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে যায় এবং জাহান্নামের খোরাক হয়।
এ আয়াতের অন্য আরেকটি অর্থ হতে পারে যে, দৈহিক ও জ্ঞানগত শক্তির পূর্ণতা লাভের পর মানুষ বার্ধক্যের ন্যুব্জতা ও শীর্ণতা এবং জ্ঞানগত ত্রুটি ও স্মৃতিহীনতা ইত্যাদির মাধ্যমে নিকৃষ্টতর অবস্থার দিকে ধাবিত হয়। মানুষ শত চেষ্টা করেও তার যৌবনকে ধরে রাখতে পারে না এবং বার্ধক্যকে ঠেকাতে পারে না। এমনিভাবে শত চেষ্টা করেও সে তার মৃত্যু ও পুনরুত্থানকে ঠেকাতে পারবে না এবং পাপাচারী যালেমরা জাহান্নামকে ঠেকাতে পারবে না।
(৬) اِلَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَلَهُمۡ اَجۡرٌ غَیۡرُ مَمۡنُوۡنٍ
“ইল্লাল্লাযীনা আ-মানু অ’আমিলুছ্ ছয়া-লিহা-তি ফালাহুম্ আজ্ব্রুন্ গইরু মাম্নুন্”
‘তবে তারা ব্যতীত, যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করেছে, তাদের জন্য রয়েছে অবিচ্ছিন্ন পুরস্কার।’
এ আয়াতে সৎকর্মশীলগন মুমিনগন এর ব্যতিক্রম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, মুমিন সৎকর্মী বার্ধক্য অক্ষম ও অপারগ হয় না। বরং উদ্দেশ্য এই যে, তাদের দৈহিক বেকারত্ব ও বৈষয়িক অকর্মণ্যতার ক্ষতি তাদের হয় না। বরং ক্ষতি কেবল তাদের হয় যারা নিজেদের সমগ্র চিন্তা ও যোগ্যতা বৈষয়িক উন্নতিতেই ব্যয় করেছিল। এখন তা নিঃশেষ হয়ে গেছে এবং পরকালে তাদের কোন অংশ নেই। কিন্তু মুমিন সৎকর্মীর পুরস্কার ও সওয়াব কোন সময়ই নিঃশেষ হয় না। তাদের পুরস্কার সব সময়ই অব্যাহত থাকবে।
(৭) فَمَا یُکَذِّبُکَ بَعۡدُ بِالدِّیۡنِ ؕ
“ফামা-ইয়ুকায্যিবুকা বা’দু বিদ্দীন্”
‘ অতঃপর এরপরেও কোন্ বস্ত্ত তোমাকে ক্বিয়ামত দিবসে মিথ্যারোপে প্ররোচিত করছে?’
এতে কেয়ামতে অবিশ্বাসীদেরকে হুশিয়ার করা হয়েছে যে, আল্লাহর কুদরতের উপরোক্ত দৃশ্য ও পরিবর্তন দেখার পরও তোমাদের জন্যে পরকাল ও কেয়ামতকে মিথ্যা মনে করার কি অবকাশ থাকতে পারে।
(৮) اَلَیۡسَ اللّٰهُ بِاَحۡکَمِ الۡحٰکِمِیۡنَ
“আলাইসাল্লা-হু বিআহ্কামিল্ হা-কিমীন্”
‘আল্লাহ কি সকল বিচারকের শ্রেষ্ঠতম বিচারক নন?’
অর্থাৎ হে হঠকারী ব্যক্তিগণ! আল্লাহ কি শ্রেষ্ঠ বিচারক নন? আর সেজন্যেই তো ক্বিয়ামত হবে। যাতে অহংকারী যালেমদের কাছ থেকে মযলূমদের পক্ষে যথাযথ বদলা আদায় করা যাবে। যালেমরা যুলুম করে পার পেয়ে যাবে, আর মযলূমরা কেবল মুখ বুঁজে যুলুম বরদাশত করে যাবে- তার কোন প্রতিদান তারা পাবে না, এটা তো ইনছাফ নয়। সেজন্য ক্বিয়ামত অবশ্যই হবে এবং ন্যায়বিচার অবশ্যই হবে। অতএব আল্লাহ কি শ্রেষ্ঠ বিচারক নন? জবাব, অবশ্যই তিনি শ্রেষ্ঠ বিচারক। এর মধ্যে যালিম, কাফির ও মুনাফিকদের প্রতি কঠোর ধমকি ও দুঃসংবাদ রয়েছে।