সূরা নাসের সংক্ষিপ্ত তাফসীর

সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস আলাদা দু’টি সূরা হলেও এদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিষয়বস্তু পরস্পরের সাথে এতবেশি সম্পর্কিত যে, এদেরকে একত্রে “মু’আওবিযাতাইন” (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার দু’টি সূরা) নামে ডাকা হয়। আর এই সূরা দু’টি নাযিলও হয়েছে একই সাথে একই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।

 মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে, জনৈক ইহু্দী রাসূলুল্লাহ্‌ (সা:)এর উপর জাদু করেছিল। ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। জিবরাঈল (আ:) আগমন করে সংবাদ দিলেন যে, জনৈক ইহু্দী জাদু করেছে এবং যে জিনিসে জাদু করা হয়েছে, তা অমুক কুপের মধ্যে আছে। রাসূলুল্লাহ্‌ (সা:) লোক পাঠিয়ে সেই জিনিস কূপ থেকে উদ্ধার করে আনলেন। তাতে কয়েকটি গিরা ছিল। উনি এই সূরা দুটি পড়ে ফুঁক দেওয়ায় সংগে সংগে গিরাগুলো খুলে যায় এবং উনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে শয্যাত্যাগ করেন।(তাফসীরে মাআরেফুল কোরআন)।

হযরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্‌ (সা:)- এর উপর জাদু করলে তার প্রভাবে তিনি মাঝে মাঝে দিশেহারা হয়ে পড়তেন এবং যে কাজটি করেননি, তাও করেছেন বলে অনুভব করতেন। একদিন তিনি হযরত আয়েশা (রা:)-কে বললেনঃ আমার রোগটা কি, আল্লাহ্ তা'আলা তা আমাকে বলে দিয়েছেন। (স্বপ্নে) দুজন ব্যক্তি আমার কাছে আসল এবং একজন শিয়রের কাছে ও অন্যজন পায়ের কাছে বসে গেল। শিয়রের কাছে উপবিষ্ট ব্যক্তি অন্য জনকে বলল, তাঁর অসুখটা কি? অন্যজন বললঃ ইনি জাদুগ্রস্ত। প্রথম ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলঃ কে জাদু করেছে? উত্তর হল, ইহুদীদের মিত্র মুনাফিক লবীদ ইবনে আ'সাম জাদু করেছে। আবার প্রশ্ন হলঃ কি বস্তুতে জাদু করেছে? উত্তর হল, একটি চিরুনীতে। আবার প্রশ্ন হল, চিরুনীটি কোথায়? উত্তর হল, খেজুর ফলের আবরণীতে 'বির যরোয়ান' কূপে একটি পাথরের নিচে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্‌ (সা:) কূপে গেলেন এবং বললেনঃ স্বপ্নে আমাকে এই কূপটিই দেখানো হয়েছে। অতঃপর চিরুনীটি সেখান থেকে বের করে আনলেন। 

আসুন সূরাটি পড়ে নেই:-

সূরা নাস। প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহর তিনটি গুণাবলীর বর্ণনা করা হয়েছে। পরের তিনটি আয়াতে জ্বিন ও মানবরূপী শয়তানের কুমন্ত্রণা হতে আল্লাহর আশ্রয় চাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

(১) قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ

“ক্বুল আউযু বিরাব্বিন নাস”

‘বলুন! আমি আশ্রয় চাচ্ছি মানুষের পালনকর্তার’

২) مَلِكِ النَّاسِ

“মালিকিন্নাস” 

‘মানুষের অধিপতির’

(৩) إِلَهِ النَّاسِ

“ইলাহিন্নাস” 

‘মানুষের উপাস্যের’

উপরে বর্ণিত তিনটি আয়াতে আল্লাহর তিনটি গুনের বর্ণনা করা হয়েছে। রুবূবিয়াত, মালেকিয়াত ও উলূহিয়াত। তথা, লালন-পালন, আধিপত্য ও উপাসনা। এই তিন গুণের একচ্ছত্র মালিকানা শুধুমাত্র আল্লাহর। 

প্রথম গুণ হিসাবে বলা হয়েছে ‘মানুষের পালনকর্তা’। সকল মানুষ আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা হিসাবে মানে। কিন্তু পালনকর্তা হিসাবে মানতে অনেকেই আপত্তি করে। যেমন ফেরাঊন সরাসরি অস্বীকার করেছিল এবং নিজেকেই ‘আমি তোমাদের বড় পালনকর্তা’ বলে দাবী করেছিল (নাযে‘আত ৭৯/২৪)। পৃথিবীতে ফেরাঊনী স্বভাবের অসংখ্য ধনী, সমাজনেতা ও রাষ্ট্রনেতা রয়েছেন, যারা পরোক্ষেভাবে অনুরূপ দাবী করতে চান। তাই আল্লাহ এখানে তাঁর ‘পালনকর্তা’ গুণটিকেই শুরুতে এনেছেন। 

দ্বিতীয় গুণ:  ‘মানুষের অধিপতি’। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ পৃথিবীকে কব্জায় নিবেন আর বলবেন, ‘আমিই বাদশাহ। পৃথিবীর রাজা-বাদশাহরা কোথায়’?[বুখারী /৬৫১৯]

পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজ ও রাষ্ট্রনেতারা সাধারণতঃ এই অহংকারে বুঁদ হয়ে থাকেন যে, সবার উপরে তারাই। তাদের উপরে কেউ নেই। তারা যা বলেন বা করেন, সেটাই চূড়ান্ত। সেটাই আইন। আইন ও বিধানদাতা তারাই। মানুষের উপরে মানুষের এই মেকী প্রভুত্বের বিরুদ্ধে আল্লাহ তাঁর একাধিপত্য ও একক সার্বভৌমত্বের গুণ প্রকাশ করে বলেছেন  ‘মানুষের অধিপতি’। এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, মানুষের অধিপতি মানুষ নয়, বরং আল্লাহ। 

তৃতীয় গুণ:  ‘মানুষের উপাস্য’। স্রেফ ধারণা ও কল্পনার বশবর্তী হয়ে কিছু ব্যক্তি ও বস্ত্তর উপরে অলৌকিক ক্ষমতা আরোপ করে মানুষ তাদের উপাসনা করে থাকে। তাদের কবর, মূর্তি, ছবি ও প্রতিকৃতিকে পূজা করে। একইভাবে নবী-অলি, ফেরেশতা, সূর্য-চন্দ্র, আগুন-পাহাড়-নদী, পশু পর্যন্ত মানুষের পূজা পাচ্ছে। সেযুগের নমরূদ নিজেকে মানুষের হায়াত-মঊতের মালিক দাবী করে বলেছিল,  ‘আমি বাঁচাই ও আমি মারি’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮)। ফেরাঊন নিজেকে জনগণের ‘ইলাহ’ দাবী করে কওমের নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিল, … ‘আমি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন উপাস্য আছে বলে আমি জানি না’ … (ক্বাসাস ২৮/৩৮)। 

এযুগের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের অনেকে অঘোষিতভাবে অনুরূপ দাবী করেন। কুরআন-হাদীসের কল্যাণপথ তারা দেখতে পান না। ফলে তাদের জীবদ্দশায় সরাসরি এবং মৃত্যুর পরে তাদের ছবিতে ও কবরে প্রত্যক্ষ ও প্ররোক্ষভাবে পূজা হয়ে থাকে।

(৪) مِن شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ

“মিন শাররীল ওয়াস ওয়াসিল খান্নাস”

 ‘গোপন কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হতে’

অর্থাৎ, শয়তানের কুমন্ত্রণার অনিষ্টকারিতা হতে বাঁচার জন্য মানুষকে আল্লাহর আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। আল্লাহর নাম শুনলেই শয়তান পিছিয়ে যায় ও লুকিয়ে যায়। আবার যেমনি বান্দা বেখেয়াল হয়ে যায়। অমনি সে সামনে চলে আসে ও কুমন্ত্রণা দেয়। এই লুকোচুরি স্বভাবের জন্য শয়তানকে অত্র আয়াতে ‘খান্নাস’ বলা হয়েছে। আর এটা হল শয়তানের প্রথম বৈশিষ্ট্য।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, - ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার সঙ্গী হিসাবে শয়তানকে নিযুক্ত করা হয়নি। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনিও? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমিও। তবে আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছেন। সেজন্য সে অনুগত হয়ে গেছে। ফলে সে আমাকে নির্দেশ করে না ভাল ব্যতীত’।[মুসলিম /২৮১৪ ]

(৫) الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ

“আল্লাযি ইউওয়াস ইউসু ফী সুদুরিন্নাস” 

‘যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরসমূহে’

এই আয়াতে আল্লাহ বলেছেন ‘ফি সুদুরিন নাস’। এখানে আল্লাহ ‘ফি কুলুবিন নাস’ না বলে ‘ফি সুদুরিন নাস’ বলেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। ‘সুদুর’ মানে বক্ষ আর ‘কুলুব’ মানে হৃদয়। বক্ষ এবং হৃদয় আলাদা। হৃদয় থাকে বক্ষের ভিতরে। শয়তান বক্ষে কুমন্ত্রনা দেয়, হৃদয়ে নয়। সে হৃদয়ের কন্ট্রোল নিতে পারে না। এভাবে আল্লাহ আমাদের উপর রহম করেছেন।

শয়তান মানুষের হৃদয়ের পাশেই (বক্ষে) ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রনা) দিতে থাকে। সে হৃদয়ের বাইরে থেকে বারবার হৃদয়ের দরজায় নক করে (কুমন্ত্রনা দেয়)। অর্থাৎ শয়তান মানুষকে বার বার কুমন্ত্রনা দিতে থাকে এবং সে একবার ব্যর্থ হয়ে চলে যায় না বরং বার বার ফিরে আসে ও চেষ্টা করতে থাকে।

কোনভাবে যদি হৃদয়ের দরজায় খোলা হয়, তাহলে শয়তান ভিতরে প্রবেশ করতে পারে। কোন অনুপ্রবেশকারী যদি হৃদয়ের ঘরে ঢুকে যায় এবং তাকে বেশিক্ষন থাকতে দেওয়া হয় তাহলে সে তার ইচ্ছা মত কাজ করতে থাকে। মনকে পরিবর্তন করার জন্য প্ররোচনা দিতে থাকে, মানুষের হৃদয়ে কালিমা লেপনের চেষ্টা করতে থাকে। তাই শয়তানের কুমন্ত্রনার কাছ থেকে রেহাই পেতে সবসময় আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে হবে। 

(৬) مِنَ الْجِنَّةِ وَ النَّاسِ

“মিনাল জিন্নাতি ওয়ান নাস।”

 ‘জ্বিনের মধ্য হতে ও মানুষের মধ্য হতে।’

এখানে শয়তানকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। জ্বিন শয়তান, যা মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। এবং মানুষ শয়তান, যা প্রকাশ্যে মানুষকে কু-পরামর্শ দেয় ও পথভ্রষ্ট করে।

আল্লাহ বলেন, ‘আর এমনিভাবে আমি প্রত্যেক নবীর জন্য বহু শয়তানকে শত্রুরূপে নিযুক্ত করেছি মানুষের মধ্য থেকে ও জ্বিনদের মধ্য থেকে। তারা একে অপরকে মনোমুগ্ধকর কথা দিয়ে প্ররোচিত করে থাকে। যাতে তারা ধোঁকায় পতিত হয়। যদি তোমার প্রভু চাইতেন, তাহলে তারা এগুলি করতে পারত না। অতএব তুমি এদেরকে ও এদের মিথ্যা রটনাগুলিকে দূরে নিক্ষেপ কর’ (আন‘আম ৬/১১২)। 

এই যুগেও জ্বিন শয়তান ও মানুষ শয়তানের মত অনেক পথহারা আছে, যারা মানুষের মনে কুমন্ত্রনা দান করছে ও বিভ্রান্ত করছে। যার ফলে নিজের কামনা বাসনাকে ‘ইলাহ’ বানিয়ে নেওয়া মানুষের সংখ্যাও অনেক। সূরা নাস ঐ সব কুমন্ত্রনা ও বিভ্রান্তকারী জ্বীন ও মানুষ থেকে এবং নিজের কামনা বাসনা, ঔদ্ধত্য, আবাধ্যতা থেকে আশ্রয় গ্রহন করে তাওহীদ ও ইসলামকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখার মূলমন্ত্র হিসাবে কাজ করে। 

আল কুরআনের এই শেষ সূরায় মানুষের সবচাইতে আপন ও শুভাকাঙ্খী হিসাবে আল্লাহ নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আর সাথে সাথে সবচাইতে ক্ষতিকর শত্রু শয়তানকেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। শয়তানের প্ররোচনা থেকে বেঁচে আল্লাহর আনুগত্য করাই মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্য। এটি আল্লাহ বোঝাতে চেয়েছেন ‘মানুষ’ নামের কোরআনের সর্বশেষ এই সূরায়।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম