"আজ আমার মন খারাপ" - এমন স্টাটাস ফেসবুকে দিলেও শাস্তি হতে পারে বলে খসড়া আইন তৈরী হয়েছে। আর "মন খারাপ" বর্তমানে তরুণ-তরুণীদের একটা কমন প্রব্লেম। আমাদের জীবন ফুলশয্যাময় নয়। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে কষ্টনির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা আল-বালাদ, আয়াত : ৪)
বেকারত্ব, বিয়েতে বিলম্ব, পারিবারিক চাপ, পিতা-মাতার সাথে মানসিক দ্বন্দ, হতাশা, বিষন্নতা সব মিলে একটা ভজঘট অবস্থা। এই রকম একটা অবস্থায় মন ভাল রাখাও অনেক কষ্টের। কারো আনন্দ-শোক বা হাসি-কান্না তার আয়ত্তাধীন নয়। এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। আল্লাহ পাক জানেন যে তার বান্দা এরকম অবস্থায় পড়বে এবং এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায়ও তিনি বাতলে দিয়েছেন। মন খারাপের সময়গুলো কিভাবে অতিক্রম করতে পারি, আসুন সে সম্পর্কে জানি-
১। পবিত্র কুরানে আল্লাহ তায়ালা বলেন–
أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
“নিশ্চয় আল্লাহর জিকিরে রয়েছে অন্তরের প্রশান্তি”
অতএব মন খারাপ হলে আল্লাহর জিকির করুন মন ভালো হয়ে যাবে, ইন শা আল্লাহ৷
২। মনোযোগ সহকারে কুরান শুনলে বা তেলাওয়াত করলে আল্লাহর অশেষ রহমত বর্ষিত হয় এবং মনের কষ্ট ও যন্ত্রনা কম হয়৷
৩। মন খারাপ হলে নতুন পোষাক পরিধান করুন আর খসবু লাগান। দেখবেন মন ভালো থাকবে৷
৪। যখন বিষন্নতা ভর করবে তখন একাকি না থেকে ভালো বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করুন৷ আশাকরি মন ভালো হয়ে যাবে ৷
৫। মন ভালো রাখতে ও দুশ্চিন্তা দূর করতে হাসিখুশি থাকতে নামাজের কোন বিকল্প নেই। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত আদায় করলে শরীর ও মন উভয়ই ভালো থাকে।
৬। অসহায় মানুষকে সাহায্য করলে, গরীব দুঃখীকে দান করলে মনের ভিতর অনেক শান্তি লাভ হয়। মানুষকে দান করলে মানুষের বিপদে সাহায্য করলে, পৃথিবীতে ভালো থাকা যায় এবং আখেরাতেও এর মূল্য পাওয়া যায়।
৭। বেশি পরিমাণে একে অন্যকে সালাম দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। অন্তরে প্রশান্তি লাভ হয়। সওয়াবে জীবন ধন্য হয়। সালাম মানে পারস্পরিক শান্তির দোয়া করা। পুরুষ ও নারী সবার মধ্যে এ গুণটি থাকা উচিত। নারী-পুরুষ সবাইকে উদ্দেশ করে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের মধ্যে সালামের প্রসার ঘটাও।’ (মুসলিম, হাদিস : ৫৪)
৮। দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার জন্য বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত শরীফে নিন্মোক্ত দোয়াটি বর্ণিত হয়েছে। আমরা এটি পড়তে পারি-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَ أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبُخْلِ وَالْجُبْنِ، وَ أَعُوذُ بِكَ مِنَ ضَلَعِ الدَّيْنِ، وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ
উচ্চারণঃ ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়া আউযু বিকা মিনাল বুখলি ওয়াল জুবনি, ওয়া আউযু বিকা মিন দ্বালা’য়িদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।’
অর্থঃ হে আল্লাহ, নিশ্চয়ই আমি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে আপনার আশ্রয় চাই, অপারগতা ও অলসতা থেকে আপনার আশ্রয় চাই, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে আপনার আশ্রয় চাই আর ঋণের ভার ও মানুষদের দমন-পীড়ন থেকেও আপনার আশ্রয় চাই।
৯। বদ্ধ ঘর থেকে বের হয়ে কোনও বাগানে বসে রঙ-বেরঙ্গের ফল-ফুল ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা, ঘরের ছাদের বসে নীল আসমান ও চাঁদ-তারাদের সৌন্দর্য অবলোকন করা অথবা নদী বা সাগর তীরে পানির কাছাকাছি কিছুক্ষণ সময় কাটালে মন ভালো হয়ে যায়।
১০। এছাড়াও নফল সালাত আদায় করুন এবং দীর্ঘ সময় সেজদায় কাটান। এ সময় কষ্টের কথাগুলো আল্লাহর নিকট বলে তাঁর কাছে দুআ করুন। প্রিয়জনের সাথে কথা বলুন বা সময় কাটান। পছন্দের কোন হালাল খাবার খান। যাদের সাথে কথা বললে বা থাকলে মন খারাপ হয় তাদের থেকে দূরে থাকুন অথবা যে জিনিসগুলো চিন্তা করলে মন খারাপ হয় সে সব চিন্তা মাথা থেকে দূর করুন।
আমাদের জীবন একাধারে সুখের সমুদ্র না আবার দুঃখের নদীও না। সুখ ও দুঃখ পর্যায়ক্রমে আমাদের জীবনে আসবেই। জীবনের ভাঙা-গড়ার এ দর্শন যে উপলব্ধি করতে পারে, সাময়িক আনন্দকে সে চূড়ান্ত জ্ঞান করে না। সুখ ও ভোগে গা ভাসিয়ে দেয় না। আবার দুঃখের দিনে আশাহত হয় না। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না। আসুন, নবীদের জীবনের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিই।
১। আপনি অবরুদ্ধ, ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। মন ভীষণ খারাপ? কত দিন ধরে? তিন মাস? চার মাস? এক বছর? আপনি কি জানেন আমাদের প্রিয় নবী (সা.) তিন বছর পর্যন্ত শুআবে আবু তালেবে কাফিরদের দ্বারা অবরুদ্ধ-বেষ্টিত ছিলেন। একসময় খাদ্যের সংকট দেখা দেয়। এমনও হয়েছে, তিনি ক্ষুধার তাড়নায় গাছের পাতা খেয়েছেন। আপনার দুঃখ-কষ্ট কি এর চেয়েও বেশি?
২। যখন রক্তসম্পর্কীয় কেউ আপনার সঙ্গে প্রতারণা করে, ভেঙে পড়বেন না। মনে রাখবেন, ইউসুফ (আ.) নিজ ভাইদের দ্বারা প্রতারিত ও গভীর কূপে নিক্ষিপ্ত হয়েও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
৩। মাতা-পিতা থেকে কষ্ট পেলে মন খারাপ করবেন না। ইবরাহিম (আ.) নিজ পিতার দ্বারাই আগুনে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।
৪। ঘোর বিপদে চারদিকে অন্ধকার দেখলেও হতাশ হবেন না। ইউনুস (আ.) সাগরে মাছের পেটের অন্ধকার প্রকোষ্ট থেকেও উদ্ধার হয়েছিলেন।
৫। আপনার বিরুদ্ধে অপবাদ ও গুজব রটলে ভেঙে পড়বেন না। আয়েশা (রা.)-এর বিরুদ্ধেও অপবাদ আরোপ করা হয়েছিল। আল্লাহ তাঁকে হেফাজত করেছেন।
৬। তীব্র অসুস্থতায় হতাশ হবেন না। আইয়ুব (আ.) আপনার চেয়ে হাজার গুণ বেশি অসুস্থ ছিলেন। পরে তিনি সুস্থ হয়েছেন।
৭। যখন আপনি নির্জন ও একাকিত্বে ভোগেন, ভেঙে পড়বেন না। আদম (আ.)-কে, প্রথমে একাকী সঙ্গীবিহীন সৃষ্টি করা হয়েছিল। অথচ তিনিই এ পৃথিবীকে আবাদ করেছেন।
৮। পরিবার ও সন্তানকে সৎপথে আনার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলেও হতাশ হবেন না। চেষ্টা চালিয়ে যান। নুহ (আ.) সাড়ে নয় শ বছর দাওয়াত দিয়ে মাত্র ৮০ জনকে হেদায়েতের পথে আনতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি তো আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাবেন।
৯। মানুষ আপনাকে নিয়ে বিদ্রুপ করলে ভেঙে পড়বেন না। আমাদের নবীসহ যুগে যুগে সব নবীকে নিয়ে অজ্ঞ ও অবিশ্বাসীরা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছিল, কিন্তু পরিশেষে নবীরাই সফল হয়েছেন।
১০। একের পর এক বিপদে হতাশ হবেন না। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের বেশি বেশি পরীক্ষায় ফেলেন। নবী-রাসুলদের তিনি সর্বাধিক পরীক্ষা করেছেন। পরিশেষে তাঁদের উদ্ধার করেছিলেন।
কাজেই আসুন, আমরা আল্লাহমুখী হই। আল্লাহর জিকিরে সদা মশগুল থাকি, সৃষ্টিকর্তার স্মরণে মনকে সব সময় তরতাজা রাখি - সব দুঃখ মুছে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
