ঐতিহাসিক বদর দিবস এবং এই দিবসের শিক্ষা

(১) ২য় হিজরী সনের ১৭ই রামাদ্বানের ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের সাথে কাফির-মুশরিকদের সর্বপ্রথম মুখোমুখি সশস্ত্র সংঘর্ষ। বদর যুদ্ধে মুসলমান ছিল মাত্র ৩১৩ জন। অপর পক্ষে কাফিরদের সংখ্যা ছিল ১০০০-এর বেশি। মুসলমানদের মধ্যে ৮৫ জন ছিলেন মুহাজির সাহাবি। বাকি সবাই মদিনার আনসার। ৩১৩ জনের দলে উট ছিল ৭০টি। আর ঘোড়া ছিল মাত্র ২টি। অপরদিকে কাফিরদের এক হাজারের দলের ৬০০ জনের কাছেই ছিল বর্ম এবং ঘোড়া ছিল ২০০টি। 

(২) এটি ছিল হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী অথচ একটি অসম যুদ্ধ। কেননা একটি সুসজ্জিত এবং সংখ্যায় তিনগুণ অধিক ও প্রশিক্ষিত সেনাদলের সাথে অপ্রস্ত্তত, অসজ্জিত এবং সংখ্যায় তিনগুণ কম এবং বাস্তভিটা হারা মুহাজির ও নওমুসলিম আনসারদের এ যুদ্ধে জয়লাভ ছিল এক অকল্পনীয় ব্যাপার। এ কারণেই এ যুদ্ধের দিনটিকে পবিত্র কোরআনে ‘ইয়াওমুল ফুরক্বান’ বা কুফর ও ইসলামের মধ্যে ‘ফায়সালাকারী দিন’ (সুরা আনফাল ৮/৪১) বলে অভিহিত করা হয়েছে ।

(৩) বদরের এ দিনটিকে আল্লাহ স্মরণীয় হিসাবে উল্লেখ করে বলেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো’ (আল ইমরান ৩/১২৩)।

(৪) বদরের যুদ্ধ ছিল কাফেরদের মূল কর্তনকারী ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা দানকারী। এ যুদ্ধের পরে কাফের সমাজে এমন আতংক প্রবেশ করে যে, তারা আর কখনো বিজয়ের মুখ দেখেনি।

(৫) এ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মুসলমানদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পায়। দলে দলে লোকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। এমনকি মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ প্রকাশ্যে ইসলাম কবুল করে। শত্রুরা ভীত হয়ে চুপসে যায়।

(৬) বদরের যুদ্ধের বিজয় ছিল মক্কা বিজয়ের সোপান স্বরূপ। এই সময় শা‘বান মাস থেকে কা‘বার দিকে কিবলা পরিবর্তিত হয় এবং বদর যুদ্ধের মাত্র ছয় বছর পরেই ৮ম হিজরীর ২০ রামাদ্বানে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে যা পূর্ণতা লাভ করে।

বদর যুদ্ধের শিক্ষা :

১) মক্কায় পরিবেশ প্রতিকূলে থাকায় সেখানে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে মদীনায় পরিবেশ অনুকূলে থাকায় এবং এখানে সবাই রাসূল (সাঃ)এর নেতৃত্ব মেনে নিতে মৌখিক ও লিখিতভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার ফলে মুসলমানেরা চালকের আসনে থাকায় রাসূল (সাঃ)কে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়। এতে বুঝা যায় যে, বিজয়ের সম্ভাবনা ও পরিবেশ না থাকলে যুদ্ধের ঝুঁকি না নিয়ে সবর করতে হবে। যেমনটি মাক্কী জীবনে করা হয়েছিল।

(২) বদরের যুদ্ধ ছিল মূলতঃ আত্মরক্ষামূলক। আবূ জাহলকে বদরে মুকাবিলা না করলে সে সরাসরি মদীনায় হামলা করার দুঃসাহস দেখাত। যা ইতিপূর্বে তাদের একজন নেতা কূরয বিন জাবের ফিহরী সরাসরি মদীনার উপকণ্ঠে হামলা করে গবাদিপশু লুটে নেবার মাধ্যমে জানিয়ে গিয়েছিল। এতে বুঝা যায় যে, আত্মরক্ষা এবং ইসলামের স্বার্থ ব্যতীত অন্য কোন কারণে কাফেরদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি নেই।

(৩) সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের কমবেশী বিজয়ের মাপকাঠি নয়। বরং আল্লাহর উপরে দৃঢ় ঈমান ও তাওয়াক্কুল হ’ল বিজয়ের মূল হাতিয়ার। পরামর্শ সভায় কয়েকজন সাহাবী বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে যুদ্ধ না করে ফিরে যাবার পরামর্শ দিলে আল্লাহ ধমক দিয়ে আয়াত নাযিল করেন (আনফাল ৮/৫-৬)। এতে বুঝা যায়, আল্লাহর গায়েবী মদদ লাভই হলো বড় বিষয়।

(৪) যুদ্ধের উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। যেটা যুদ্ধ শুরুর প্রথম নির্দেশেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সাহাবীগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। অতএব চিন্তাক্ষেত্রের যুদ্ধ হোক কিংবা সশস্ত্র মোকাবিলা হোক। ইসলামের সৈনিকদের একমাত্র লক্ষ্য থাকতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। কোন অবস্থাতেই দুনিয়া হাসিলের জন্য মুসলমানের চিন্তাশক্তি বা অস্ত্র শক্তি ব্যয়িত হবে না।

(৫) শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধে নামলে আল্লাহ স্বীয় ফেরেশতা মন্ডলী পাঠিয়ে সরাসরি সাহায্য করে থাকেন। যেমন বদর যুদ্ধের শুরুতে রাসূলের বালু নিক্ষেপের মাধ্যমে (আনফাল ৮/১৭) অতঃপর ফেরেশতাদের সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাহায্য করা হয়েছিল (আনফাল ৮/৯)।

(৬) যুদ্ধে গনীমত লাভের মাধ্যমে দুনিয়া অর্জিত হলেও তা কখনোই মুখ্য হবে না। বরং সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী সেনাপতির অনুগত থাকতে হবে। বদর যুদ্ধে গনীমত বণ্টন নিয়ে বিবাদ উপস্থিত হলেও তা সাথে সাথে নিষ্পত্তি হয়ে যায় রাসূল (সাঃ)এর নির্দেশে এবং আয়াত নাযিলের মাধ্যমে (আনফাল ৮/১)।

(৭) কাফিররা মুসলমানদের সংখ্যা ও অস্ত্র শক্তিকে ভয় পায় না। বরং তারা ভয় পায় মুসলমানের ঈমানী শক্তিকে। বদরের যুদ্ধের পরে সে ভয় সমস্ত কুফরী শক্তিকে গ্রাস করেছিল। এ কারণেই পরবর্তী ওহুদের যুদ্ধে তারা মহিলাদের সাথে করে এনেছিল। যাতে পুরুষেরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে না পালায়।

(৮) বদর যুদ্ধের বড় শিক্ষা এই যে, কুফর ও ইসলামের মুকাবিলায় মুসলমান নিজের সীমিত শক্তি নিয়ে আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুল করে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর এভাবেই চিরকাল ঈমানদার সংখ্যালঘু শক্তি বেঈমান সংখ্যাগুরু শক্তির উপরে বিজয়ী হয়ে থাকে (বাক্বারাহ ২/২৪৯)। এই ধারাবাহিকতা ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে।

এটি ছিল একটি মহা অলৌকিক বিজয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছে) তাদের তোমরা কেউই হত্যা করোনি; বরং আল্লাহ তায়ালাই তাদের হত্যা করেছেন। আর তুমি যখন (তাদের প্রতি) তীর নিক্ষেপ করেছিলে, মূলত তুমি নিক্ষেপ করোনি, বরং করেছেন আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং’ (সূরা আনফাল : ১৭)।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম