আমার ল্যাপটপ। খুব আদরের জিনিস। আমি একে মহব্বত করে ল্যাপী বলে ডাকি। অবশ্য কোন ঝামেলা দেখা দিলে মৃদু রাগ করে হালকা-পাতলা চড়-থাপ্পড় মারি। আছাড় খাওয়ার ভয়ে সাথে সাথে ঠিক হয়ে যায়।
সকাল ভোর থেকে শুরু করে রাত ১২/১/৩/৫ টা পর্যন্তও আমি ল্যাপী নিয়ে বসে থাকি। আমি এই ল্যাপী ছাড়া কোথাও গিয়ে ১/২ রাতের বেশি কাটাতে পারিনা। সারাদিন মাউস আর কি-বোর্ড টেপাই আমার কাজ। আমার পরিবারের সদ্যসরা বলে, ঘুমের মধ্যেও নাকি আমি এটা-সেটা টিপে ধরি। আমি এটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিই। কারণ এস.এস.সি পরীক্ষার সময় যখন সারাদিন পড়তাম তখন ঘুমের মধ্যেও স্বপ্ন দেখতাম যে পড়তেছি। স্বপ্নের মধ্যে পড়তে পড়তে মুখ বিড়-বিড় করতাম, ঐভাবে অনেক সময় ঘুমও ভেঙ্গে যেত। কিন্ত এখন যেহেতু সারাদিন মাউস আর কী-বোর্ড টিপি তাই ঘুমের ঘোরে এটা-সেটা টিপ দেয়া বা বালিশ টিপ দেয়াও স্বাভাবিক।
আমার বড় বোনের একমাত্র মেয়ের বিয়ে। তাই একমাত্র মামা হিসাবে আমার অনেক দায়িত্ব। ছেলে দেখা থেকে শুরু করে একেবারে বিয়ের পরে জামাই-মেয়ে আনা-নেয়াও আমার দায়িত্বের মধ্যে। কিন্ত বোনের বাড়ী যাওয়ার সময় আমি ল্যাপী নিতে ভুলে গেলাম। কঠোরভাবে দুই দিন দায়িত্ব পালনের পর মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। অনেক কষ্টে কোনক্রমে রাতটা পোহালেই আমি কাউকে না জানিয়ে বোনের বাড়ী থেকে চলে আসলাম। ল্যাপীর সামনে বসলাম, প্রশান্তিতে বুকটা ভরে গেল। পরে দুলাভাই এসে আমাকে ও ল্যাপ্টপ একসাথে নিয়ে গিয়েছিল।
ল্যাপী নিয়ে আমি যে খুব কাজ করি, এমনটাও না। অথবা আমি যে খুব কাজের ছেলে, তাও বলব না। সারাদিন কয়েক লাইন প্রোগ্রামিং কোড লেখা আর অনলাইনে প্রোগ্রামিং রিলেটেড ফোরাম ঘাটাই আমার কাজ।
একবার হল কি! আমার প্রচন্ড জ্বর এল। বাসায় থার্মোমিটার ছিল, মেপে দেখি তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রী। তাপে গা পুড়ে যাচ্ছে। আবার প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে। জ্বরের ঠেলায় একেবারে হাড়-কাপানো ঠান্ডা লাগছে। ঠক-ঠক করে কাপতেছি। মা গায়ে বড় বড় বিদেশী উলের কম্বল পেচিয়ে দিল। ঠক-ঠক করা একটু কমলো। সারাদিন শুয়ে থাকলাম। কিন্ত জ্বর তেমন কমলো না। মা আমাকে বিছানা থেকে উঠতেও দিচ্ছেনা। সন্ধ্যায় মা পাশের বাসায় গেল। আমি গায়ে কম্বল পেচানো অবস্থায় ল্যাপটপের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। কম্বলের ভিতর থেকে হাত বের করতেই দেখি বুড়ো মানুষের মত ঠক-ঠক করে কাপতেছে। তারপর সেই কাপা হাতে ল্যাপীর সুইচে হাত দিলাম। আমার টিপ দেয়া লাগলো না। ঠক-ঠকানির ফলে টিপ লেগে ল্যাপী অটোমেটিক অন হয়ে গেল। তারপর আলো জ্বলে লেখা আসলো Welcome. মনে হল আমার জ্বর ১০৪ থেকে নেমে ১০০ তে আসলো। তারপর বাড়ী এসে উনি যখন দেখলো আমি ল্যাপীর সামনে বসে আছি, সে এক এলাহী কান্ড শুরু হয়ে গেল।
আমার এই ল্যাপী প্রীতি দেখে মা ভাবে আমার ঘাড়ে জ্বীন-ভুত-টুত আছে মনে হয়। এজন্য উনি কয়েকবার বিভিন্ন জনের কাছ থেকে তাবিজ-কবজ এনেছে। কিন্ত কিছুতে কিছু কাজ হয়নি। একদিন আমাকে বলে তোর মাথার একটা চুল দে। আমি বললাম, চুল নিয়ে কি করবা? বললো যে একজনের কাছ তাবিজ এনেছি তোর জন্যে, সেটাতে লাগবে। বুঝে গেলাম ল্যাপী প্রীতি দূর করার তাবিজ। কিন্ত আমিতো এই প্রেম ছাড়তে চাইনা। তাই আমি আর দেইনি। অথচ উনি যদি ঘুমের মধ্যে নিয়ে নিত, তাহলে আমি টের পেতাম না। হা হা হা।
আরেকদিন বলল তোর বালিশটা দে, তু্লো পুরে দেয়া লাগবে। আমি দিলাম। কয়েকদিন পর আবিষ্কার করলাম আমার বালিশের মধ্যে একটা মাদুলি। আমি সেটা বের করে ফেলে দিলাম। এছাড়া আরেকদিন আমার ল্যাপীর নিচে একটা তাবিজের কাগজ পেলাম। আরবী হরফ ও নকশা করে সেখানে অনেক কিছু লেখা। আমি যেহেতু ছোটবেলা থেকে সোলেমানী খাবনামা-ফালনামা, লজ্জাতুন্নেছা, মোকছুদুল মোমেনীন, জশনে তাবরেজ সহ অনেক প্রকার ফুটপাত ও উচু লাইব্রেরীর বই পড়ে আসছি, সেহেতু এই তাবিজের কাগজের অর্থ আমি সহজে বুঝতে পারলাম। তাই সেটাও ফেলে দিলাম। আর আমার মায়ের এই অভ্যাস গুলা পুরাতন। আমি ছোটবেলায় প্রচন্ড দুষ্টুমি করতাম। সেজন্যও উনি তাবিজের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্ত আমি এসবে বিশ্বাস করতাম না। মা খুব আফসোস করে বলত তাবিজের গুণে নাকি অনেকে অনেক কিছু করে, কিন্ত তোর ক্ষেত্রে কেন সেটার কোন প্রভাব পড়েনা? আমি শুধু মুচকি হাসি :)
আমি কোন আত্নীয়-স্বজনের বাড়ীতে গেলে একরাতের বেশি থাকিনা। হোক সেটা যতই রক্তের বাধনের আত্নীয়। এজন্য অনেক আত্নীয় আমার উপর ক্ষ্যাপা। তার মধ্যে আমার দুই বোন অন্যতম। অবশ্য তাতে আমার কিছু যায়-আসেনা। কিন্ত যেসব আত্নীয়ের বাড়ীতে আমি ল্যাপী নিয়ে যাই, সেখানে ১০/১৫ দিন করে থাকি। তখন কেউ যদি বিরক্ত প্রকাশ করে, তখন তাতেও আমার কিছু আসে-যায়না। অবশ্য কেউ আমার প্রতি বিন্দুমাত্র অবহেলা দেখালে আমি সাথে সাথেই রিএকশান দেখাই এবং সেমুখো আর কোনদিন হইনা। তাই আমার আত্নীয়রা কেউ দাওয়াত দিলে বারবার বলে দেয় যেন ল্যাপী সাথে করে নিয়ে আসি। আমিও তাদের বাড়ীতে গিয়ে আমার ভাল লাগা কিছু কমেডি ভিডিও দেখাই। আমি সেসব দেখে মুচকি হাসি, আর তারা আনন্দে লাফায় :P
প্রেম করতে গেলে নাকি সময় দিতে হয় প্রচুর। কিন্ত ল্যাপী ছাড়া আমার আর তেমন কিছু ভাল লাগেনা। আর সারাদিন যেহেতু ল্যাপীর সামনে বসে থাকি, সেহেতু নতুন কারো সাথে পরিচিত হলেও তার সাথে সময় দিয়ে কথা বলতে পারিনা। সে যেই হোক, কারো সাথে ১/২ দিনের বেশি কথা চালু রাখতে পারিনা। হয় সে বিরক্ত হয়, না হয় আমি বিরক্ত হই। তাই কোন মেয়ের সাথে প্রেম, প্রায় ইম্পসিবল। :P আমার কাছে সব সময় মনে হয় ল্যাপী ছাড়া সবকিছু অর্থহীন। কি মদ, কি নারী - সব কিছুই ছাড়তে পারি। কেউ যদি বলে ভালবাসি -আমি বলি ল্যাপীই আমার সঙ্গের সাথী। ওমর খৈয়াম বেচে থাকলে আমাকে দেখে নিশ্চয় লিখতঃ রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে। আর এই ছ্যারা ঘুমের ঘোরে মাউস-কীবোর্ড ভেবে এটা-সেটা টিপেই যাবে :P
একদিন বাড়ীতে নাই। তারপর বিকালে বাড়ীতে ঢুকে দেখি ছোটখালা আর উনার ইন্টার পড়ুয়া মেয়ে এসেছে। উনাকে দেখে আমি খুশী হলাম। কারণ, উনি আসলে অনেক করে মিষ্টি নিয়ে আসে আর আমি মিষ্টি পছন্দ করি খুব। খালাও মিষ্টি পছন্দ করে অনেক। এজন্য বলত তোকে আমার জামাই বানাব (তার মেয়ের স্বামী)। তুই আমাদের বাড়ীতে যাওয়ার সময় অনেক করে মিষ্টি নিয়ে যাবি। কিন্ত উনার সুন্দরী কিন্ত বোকা-সোকা মেয়ে আমার পছন্দ না।
আমি আমার রুমে ঢুকে দেখি খালাত বোন আমার ল্যাপীতে বসে নাটক দেখতেছে। দেখেই কেমন যেন রাগে অগ্নি শর্মা হয়ে গেলাম। আমার অনুমতি ছাড়া আমার ল্যাপীতে অন্য কেউ বসবে এটা আমি সহ্য করতে পারতাম না। কিন্ত অত বড় মেয়ে, ওকে তো মাইরও দেয়া যায়না। কি করা যায়? তাই চেয়ারসহ ওকে উচু করে তুলে নিয়ে বাইরে এলাম। ও চিৎকার বলছে ভাইয়া কি করিস, কি করিস? আমি ওর কোন কথার জবাব না দিয়ে চেয়ারসহ ওকে পুকুরের পানিতে ফেলে দিলাম। তখন আমার রাগ কিছুটা কমলো। ভ্যা ভ্যা করতে করতে ও পুকুর থেকে উঠে আসলো। শীতের দিনে বিকালে ভিজতে ওর নিশ্চয় কষ্ট হয়েছে, হোক। তাতে আমার কি? অবশ্য তার খানিক পরেই সে এক বালতি পানি আমার গায়ে ঢেলে দিয়ে ঠিকই প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছিল। এটা অবশ্য অনেক আগের কথা। তখন একটু বদমেজাজী স্বভাব ছিল। এখন মাশাল্লাহ অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে।
পরিশিষ্টঃ এরপর পরিবারের চাপে আমার বিয়ে হল, আমার বিয়েতে কোন ইচ্ছাই ছিল না। অগত্যা রাজী হয়ে যে ঘরে আমার ল্যাপটপের টেবিল, সেই ঘরেই কাজিনদের বাসর সাজাতে বললাম। সারাদিন লোকজনের চাপে ল্যাপীতে বসতে পারিনি। মনটা শুধু আকু-পাকু করছিল। তারপর মধ্যরাতে বিয়ে বাড়ীর কোলাহল থামলে বাসর ঘরে গিয়ে দেখি আমার সদ্য বিয়ে করা বউ এখনো ঘুমটা পরে বসে আছে। আমি ভেবেছিলাম এতক্ষণ ঘুমিয়ে গেছে। থাকুক বসে। আমি আস্তে আস্তে গিয়ে ল্যাপটপের চেয়ারে গিয়ে সুইচ অন করলাম। কাজে মনোযোগ দিলাম। ধীরে ধীরে কাজের মধ্যে ডুবে গেলাম। খানিকক্ষণ পর বুজতে পারলাম পায়ের কাছে কিছু যেন স্পর্শ করে যাচ্ছে। টেবিলের তলে তাকিয়ে দেখলাম বউ আমার পা ছুয়ে ছালাম করতেছে। বাহ, মেয়েটা তো ভালোই আদব-কেতাব শিখেছে। ইচ্ছে হচ্ছিল এস.এস.সি পরীক্ষার্থীরা দোয়া চাইতে আসলে যেভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একশ টাকার নতুন নোট হাতে গুজে দিতাম, আমা্র বউকেও তাই দিই। কিন্ত আমার কাছে তো এখন নতুন নোট নেই। আর বউকে আবার টাকা দিতে যাব কেন? এখন থেকে সারাজীবনই তো নিবে। এই ভেবে আর দিলাম না।
তারপর বউ খাটে গিয়ে বসে আমাকে কয়েকবার ডাক দিল তার কাছে যাওয়ার জন্য। সে ডাকে আদর-সোহাগ-ভালবাসা সবই ছিল। কিন্ত আমার মন যেন সেই ডাকে সায় দিল না। আমি আমার মতই কাজ করে যেতে লাগলাম। এক সময় ফজরের আজান দিল। খাটে তাকিয়ে দেখলাম বউ এখনো সেইভাবে বসে আছে আর ঘুমে টলছে। এরপর সকালে তার বাবাকে ফোন দিল। তার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে সে তার বাবার সাথে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল - কোনদিন যদি ল্যাপটপ প্রীতি ছাড়তে পারি, তবেই যেন তাকে নিয়ে আসতে যাই। সে অপেক্ষায় থাকবে।
[পরিশিষ্ঠাং মূল গল্পের বাইরে এবং এটা এখনো ঘটেনি। তাই এই অংশটুকু এখনই মাথা থেকে ওয়াশ করে ফেলুন। সবচেয়ে বড় কথা এমন অখাদ্য গল্প না পড়লেও চলত। যেহেতু সময় ও শ্রম দিয়ে পড়ছেন, সেহেতু সকালের শিশির মিশ্রিত তাজা গোলাপের একরাশ ধন্যবাদ।]
সকাল ভোর থেকে শুরু করে রাত ১২/১/৩/৫ টা পর্যন্তও আমি ল্যাপী নিয়ে বসে থাকি। আমি এই ল্যাপী ছাড়া কোথাও গিয়ে ১/২ রাতের বেশি কাটাতে পারিনা। সারাদিন মাউস আর কি-বোর্ড টেপাই আমার কাজ। আমার পরিবারের সদ্যসরা বলে, ঘুমের মধ্যেও নাকি আমি এটা-সেটা টিপে ধরি। আমি এটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিই। কারণ এস.এস.সি পরীক্ষার সময় যখন সারাদিন পড়তাম তখন ঘুমের মধ্যেও স্বপ্ন দেখতাম যে পড়তেছি। স্বপ্নের মধ্যে পড়তে পড়তে মুখ বিড়-বিড় করতাম, ঐভাবে অনেক সময় ঘুমও ভেঙ্গে যেত। কিন্ত এখন যেহেতু সারাদিন মাউস আর কী-বোর্ড টিপি তাই ঘুমের ঘোরে এটা-সেটা টিপ দেয়া বা বালিশ টিপ দেয়াও স্বাভাবিক।
আমার বড় বোনের একমাত্র মেয়ের বিয়ে। তাই একমাত্র মামা হিসাবে আমার অনেক দায়িত্ব। ছেলে দেখা থেকে শুরু করে একেবারে বিয়ের পরে জামাই-মেয়ে আনা-নেয়াও আমার দায়িত্বের মধ্যে। কিন্ত বোনের বাড়ী যাওয়ার সময় আমি ল্যাপী নিতে ভুলে গেলাম। কঠোরভাবে দুই দিন দায়িত্ব পালনের পর মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। অনেক কষ্টে কোনক্রমে রাতটা পোহালেই আমি কাউকে না জানিয়ে বোনের বাড়ী থেকে চলে আসলাম। ল্যাপীর সামনে বসলাম, প্রশান্তিতে বুকটা ভরে গেল। পরে দুলাভাই এসে আমাকে ও ল্যাপ্টপ একসাথে নিয়ে গিয়েছিল।
ল্যাপী নিয়ে আমি যে খুব কাজ করি, এমনটাও না। অথবা আমি যে খুব কাজের ছেলে, তাও বলব না। সারাদিন কয়েক লাইন প্রোগ্রামিং কোড লেখা আর অনলাইনে প্রোগ্রামিং রিলেটেড ফোরাম ঘাটাই আমার কাজ।
একবার হল কি! আমার প্রচন্ড জ্বর এল। বাসায় থার্মোমিটার ছিল, মেপে দেখি তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রী। তাপে গা পুড়ে যাচ্ছে। আবার প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে। জ্বরের ঠেলায় একেবারে হাড়-কাপানো ঠান্ডা লাগছে। ঠক-ঠক করে কাপতেছি। মা গায়ে বড় বড় বিদেশী উলের কম্বল পেচিয়ে দিল। ঠক-ঠক করা একটু কমলো। সারাদিন শুয়ে থাকলাম। কিন্ত জ্বর তেমন কমলো না। মা আমাকে বিছানা থেকে উঠতেও দিচ্ছেনা। সন্ধ্যায় মা পাশের বাসায় গেল। আমি গায়ে কম্বল পেচানো অবস্থায় ল্যাপটপের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। কম্বলের ভিতর থেকে হাত বের করতেই দেখি বুড়ো মানুষের মত ঠক-ঠক করে কাপতেছে। তারপর সেই কাপা হাতে ল্যাপীর সুইচে হাত দিলাম। আমার টিপ দেয়া লাগলো না। ঠক-ঠকানির ফলে টিপ লেগে ল্যাপী অটোমেটিক অন হয়ে গেল। তারপর আলো জ্বলে লেখা আসলো Welcome. মনে হল আমার জ্বর ১০৪ থেকে নেমে ১০০ তে আসলো। তারপর বাড়ী এসে উনি যখন দেখলো আমি ল্যাপীর সামনে বসে আছি, সে এক এলাহী কান্ড শুরু হয়ে গেল।
আমার এই ল্যাপী প্রীতি দেখে মা ভাবে আমার ঘাড়ে জ্বীন-ভুত-টুত আছে মনে হয়। এজন্য উনি কয়েকবার বিভিন্ন জনের কাছ থেকে তাবিজ-কবজ এনেছে। কিন্ত কিছুতে কিছু কাজ হয়নি। একদিন আমাকে বলে তোর মাথার একটা চুল দে। আমি বললাম, চুল নিয়ে কি করবা? বললো যে একজনের কাছ তাবিজ এনেছি তোর জন্যে, সেটাতে লাগবে। বুঝে গেলাম ল্যাপী প্রীতি দূর করার তাবিজ। কিন্ত আমিতো এই প্রেম ছাড়তে চাইনা। তাই আমি আর দেইনি। অথচ উনি যদি ঘুমের মধ্যে নিয়ে নিত, তাহলে আমি টের পেতাম না। হা হা হা।
আরেকদিন বলল তোর বালিশটা দে, তু্লো পুরে দেয়া লাগবে। আমি দিলাম। কয়েকদিন পর আবিষ্কার করলাম আমার বালিশের মধ্যে একটা মাদুলি। আমি সেটা বের করে ফেলে দিলাম। এছাড়া আরেকদিন আমার ল্যাপীর নিচে একটা তাবিজের কাগজ পেলাম। আরবী হরফ ও নকশা করে সেখানে অনেক কিছু লেখা। আমি যেহেতু ছোটবেলা থেকে সোলেমানী খাবনামা-ফালনামা, লজ্জাতুন্নেছা, মোকছুদুল মোমেনীন, জশনে তাবরেজ সহ অনেক প্রকার ফুটপাত ও উচু লাইব্রেরীর বই পড়ে আসছি, সেহেতু এই তাবিজের কাগজের অর্থ আমি সহজে বুঝতে পারলাম। তাই সেটাও ফেলে দিলাম। আর আমার মায়ের এই অভ্যাস গুলা পুরাতন। আমি ছোটবেলায় প্রচন্ড দুষ্টুমি করতাম। সেজন্যও উনি তাবিজের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্ত আমি এসবে বিশ্বাস করতাম না। মা খুব আফসোস করে বলত তাবিজের গুণে নাকি অনেকে অনেক কিছু করে, কিন্ত তোর ক্ষেত্রে কেন সেটার কোন প্রভাব পড়েনা? আমি শুধু মুচকি হাসি :)
আমি কোন আত্নীয়-স্বজনের বাড়ীতে গেলে একরাতের বেশি থাকিনা। হোক সেটা যতই রক্তের বাধনের আত্নীয়। এজন্য অনেক আত্নীয় আমার উপর ক্ষ্যাপা। তার মধ্যে আমার দুই বোন অন্যতম। অবশ্য তাতে আমার কিছু যায়-আসেনা। কিন্ত যেসব আত্নীয়ের বাড়ীতে আমি ল্যাপী নিয়ে যাই, সেখানে ১০/১৫ দিন করে থাকি। তখন কেউ যদি বিরক্ত প্রকাশ করে, তখন তাতেও আমার কিছু আসে-যায়না। অবশ্য কেউ আমার প্রতি বিন্দুমাত্র অবহেলা দেখালে আমি সাথে সাথেই রিএকশান দেখাই এবং সেমুখো আর কোনদিন হইনা। তাই আমার আত্নীয়রা কেউ দাওয়াত দিলে বারবার বলে দেয় যেন ল্যাপী সাথে করে নিয়ে আসি। আমিও তাদের বাড়ীতে গিয়ে আমার ভাল লাগা কিছু কমেডি ভিডিও দেখাই। আমি সেসব দেখে মুচকি হাসি, আর তারা আনন্দে লাফায় :P
প্রেম করতে গেলে নাকি সময় দিতে হয় প্রচুর। কিন্ত ল্যাপী ছাড়া আমার আর তেমন কিছু ভাল লাগেনা। আর সারাদিন যেহেতু ল্যাপীর সামনে বসে থাকি, সেহেতু নতুন কারো সাথে পরিচিত হলেও তার সাথে সময় দিয়ে কথা বলতে পারিনা। সে যেই হোক, কারো সাথে ১/২ দিনের বেশি কথা চালু রাখতে পারিনা। হয় সে বিরক্ত হয়, না হয় আমি বিরক্ত হই। তাই কোন মেয়ের সাথে প্রেম, প্রায় ইম্পসিবল। :P আমার কাছে সব সময় মনে হয় ল্যাপী ছাড়া সবকিছু অর্থহীন। কি মদ, কি নারী - সব কিছুই ছাড়তে পারি। কেউ যদি বলে ভালবাসি -আমি বলি ল্যাপীই আমার সঙ্গের সাথী। ওমর খৈয়াম বেচে থাকলে আমাকে দেখে নিশ্চয় লিখতঃ রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে। আর এই ছ্যারা ঘুমের ঘোরে মাউস-কীবোর্ড ভেবে এটা-সেটা টিপেই যাবে :P
একদিন বাড়ীতে নাই। তারপর বিকালে বাড়ীতে ঢুকে দেখি ছোটখালা আর উনার ইন্টার পড়ুয়া মেয়ে এসেছে। উনাকে দেখে আমি খুশী হলাম। কারণ, উনি আসলে অনেক করে মিষ্টি নিয়ে আসে আর আমি মিষ্টি পছন্দ করি খুব। খালাও মিষ্টি পছন্দ করে অনেক। এজন্য বলত তোকে আমার জামাই বানাব (তার মেয়ের স্বামী)। তুই আমাদের বাড়ীতে যাওয়ার সময় অনেক করে মিষ্টি নিয়ে যাবি। কিন্ত উনার সুন্দরী কিন্ত বোকা-সোকা মেয়ে আমার পছন্দ না।
আমি আমার রুমে ঢুকে দেখি খালাত বোন আমার ল্যাপীতে বসে নাটক দেখতেছে। দেখেই কেমন যেন রাগে অগ্নি শর্মা হয়ে গেলাম। আমার অনুমতি ছাড়া আমার ল্যাপীতে অন্য কেউ বসবে এটা আমি সহ্য করতে পারতাম না। কিন্ত অত বড় মেয়ে, ওকে তো মাইরও দেয়া যায়না। কি করা যায়? তাই চেয়ারসহ ওকে উচু করে তুলে নিয়ে বাইরে এলাম। ও চিৎকার বলছে ভাইয়া কি করিস, কি করিস? আমি ওর কোন কথার জবাব না দিয়ে চেয়ারসহ ওকে পুকুরের পানিতে ফেলে দিলাম। তখন আমার রাগ কিছুটা কমলো। ভ্যা ভ্যা করতে করতে ও পুকুর থেকে উঠে আসলো। শীতের দিনে বিকালে ভিজতে ওর নিশ্চয় কষ্ট হয়েছে, হোক। তাতে আমার কি? অবশ্য তার খানিক পরেই সে এক বালতি পানি আমার গায়ে ঢেলে দিয়ে ঠিকই প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছিল। এটা অবশ্য অনেক আগের কথা। তখন একটু বদমেজাজী স্বভাব ছিল। এখন মাশাল্লাহ অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে।
পরিশিষ্টঃ এরপর পরিবারের চাপে আমার বিয়ে হল, আমার বিয়েতে কোন ইচ্ছাই ছিল না। অগত্যা রাজী হয়ে যে ঘরে আমার ল্যাপটপের টেবিল, সেই ঘরেই কাজিনদের বাসর সাজাতে বললাম। সারাদিন লোকজনের চাপে ল্যাপীতে বসতে পারিনি। মনটা শুধু আকু-পাকু করছিল। তারপর মধ্যরাতে বিয়ে বাড়ীর কোলাহল থামলে বাসর ঘরে গিয়ে দেখি আমার সদ্য বিয়ে করা বউ এখনো ঘুমটা পরে বসে আছে। আমি ভেবেছিলাম এতক্ষণ ঘুমিয়ে গেছে। থাকুক বসে। আমি আস্তে আস্তে গিয়ে ল্যাপটপের চেয়ারে গিয়ে সুইচ অন করলাম। কাজে মনোযোগ দিলাম। ধীরে ধীরে কাজের মধ্যে ডুবে গেলাম। খানিকক্ষণ পর বুজতে পারলাম পায়ের কাছে কিছু যেন স্পর্শ করে যাচ্ছে। টেবিলের তলে তাকিয়ে দেখলাম বউ আমার পা ছুয়ে ছালাম করতেছে। বাহ, মেয়েটা তো ভালোই আদব-কেতাব শিখেছে। ইচ্ছে হচ্ছিল এস.এস.সি পরীক্ষার্থীরা দোয়া চাইতে আসলে যেভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একশ টাকার নতুন নোট হাতে গুজে দিতাম, আমা্র বউকেও তাই দিই। কিন্ত আমার কাছে তো এখন নতুন নোট নেই। আর বউকে আবার টাকা দিতে যাব কেন? এখন থেকে সারাজীবনই তো নিবে। এই ভেবে আর দিলাম না।
তারপর বউ খাটে গিয়ে বসে আমাকে কয়েকবার ডাক দিল তার কাছে যাওয়ার জন্য। সে ডাকে আদর-সোহাগ-ভালবাসা সবই ছিল। কিন্ত আমার মন যেন সেই ডাকে সায় দিল না। আমি আমার মতই কাজ করে যেতে লাগলাম। এক সময় ফজরের আজান দিল। খাটে তাকিয়ে দেখলাম বউ এখনো সেইভাবে বসে আছে আর ঘুমে টলছে। এরপর সকালে তার বাবাকে ফোন দিল। তার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে সে তার বাবার সাথে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল - কোনদিন যদি ল্যাপটপ প্রীতি ছাড়তে পারি, তবেই যেন তাকে নিয়ে আসতে যাই। সে অপেক্ষায় থাকবে।
[পরিশিষ্ঠাং মূল গল্পের বাইরে এবং এটা এখনো ঘটেনি। তাই এই অংশটুকু এখনই মাথা থেকে ওয়াশ করে ফেলুন। সবচেয়ে বড় কথা এমন অখাদ্য গল্প না পড়লেও চলত। যেহেতু সময় ও শ্রম দিয়ে পড়ছেন, সেহেতু সকালের শিশির মিশ্রিত তাজা গোলাপের একরাশ ধন্যবাদ।]
