ছিনতাইকারী

বিয়ের ঠিক পড়ে পড়ে অনেক স্বাস্থ্য সচেতন ছিলাম বিধায় প্রতি সন্ধায় অফিস থেকে বাসায় এসেই হাটতে যেতাম পার্কে। ট্র্যাকসুট, দামি কেডস পড়ে এমন ভাবসাব নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতাম যেন যে কেউ দেখলে ভাববে ‘আহ এই ভদ্রলোকটা কতই না স্বাস্থ্য সচেতন’। টানা ৭ দিন হাটার পর উৎসাহ শেষ হয়ে যেত, ৪/৫ মাসের লম্বা গ্যাপ, আবার দেখা যেত ৫/৬ মাস পড়ে হঠাৎ কি মনে হল, সেরকম উদ্দমে হাঁটা শুরু... তারপর বড়জোর এক সপ্তাহ। এভাবে হিসাব করলে বিগত ৫ বছর থেকেই আমি এক্সারসাইজ করি।

এরকম কোনও এক সপ্তাহের পঞ্চম কি ষষ্ঠ দিন হবে, বারিধারা পার্কে ঢুকতে যাব, এমন সময় এক পিচ্চি আমার কাছে এসে বলে যে, ‘স্যার, মিলন ভাই আপনাকে সালাম দিসে’। আমি ‘ওয়ালাইকুম সালাম’ বলে হাঁটা দিলাম। পিচ্চি আমার পিছনে আসতে আসতে বলল ‘স্যার স্যার, সালাম দিসে মানে মিলন ভাই আপনাকে বুলায়’। আমি বললাম ‘বুলাইতে থাক’... আমি হাঁটা থামাচ্ছি নাহ।

আমি জোরে জোরে হেঁটে যাচ্ছি, পিছনে তাকাচ্ছি নাহ। একটু পড়ে পিচ্চি দৌড় দিয়ে আমার সামনে এসে বলে, ‘স্যার, মিলন ভাই বলসে আপনার ভুঁড়ি গালায়ে দিব যদি এখনই উনার কাছে না আসেন’। আমি হাঁটা থামালাম; থামিয়ে বললাম ‘কই তোর মিলন’? পিচ্চি আঙ্গুল তুলে রাস্তার অপারে দুই জনের দিকে ইশারা করলো। তাকিয়ে দেখি একটা মোটরসাইকেল পার্ক করে ২ জন চেংরা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি রাস্তা পার হয়ে গেলাম ওদের কাছে... যেয়ে দেখি মোটরসাইকেল স্টার্টে রেখে দুইজন ভাবের উপর সিগারেট খাচ্ছে। আমি মোটরসাইকেলের কাছে যেয়ে বললাম, ‘কি বলতে চান বলেন’।ওরা দুইজন মোটরসাইকেলের একপাশে আর আমি একা ওপরপাশে (আমাদের মাঝখানে মোটরসাইকেল)। দুই জনের মধ্যে মোটা করে যেই জন সে বলল, ‘আপনাকে প্রায়ই দেখি আমরা এই এলাকায় হাঁটাহাঁটি করেন... আপনার বাসা ও চিনি আমরা ভাল করে... মোটরসাইকেলের উপরে যে খবরের কাগজটা আছে ওটার ভিতরে একটা কিরিচ (কিরিচ হল এক ধরনের লম্বা ছুরি) আছে। আপনার কাছে এখন যা যা আছে তা সুন্দর করে মোটরসাইকেলের উপরে রেখে হাঁটা দেন। পিছনে তাকাবেন তো কিরিচ দিয়ে খুলি তে কোপ দিব। কি বুঝলেন?’ মোটা জন যখন কথা বলছিল ছোট জন তখন ভাবের উপরে অন্য দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছিলো। রাস্তার ওপারে তাকিয়ে দেখি পিচ্চি উধাও... আশেপাশের জনগন রাস্তায় যে যার মত হাঁটাচলা করছে।

আমি হালকা ভয় পেলাম। মনে মনে ভাবলাম, পিস্তল মিস্তল নাই এদের কাছে? থাকলে তো অবশ্যই পিস্তলটাই দেখাত। বারিধারা এতো সিকিউরড জায়গা আর রাস্তায় যেহেতু অনেক লোকজন হাঁটা চলা করছে সুতরাং আমি দৌড় দিলে তো আর কিরিচ নিয়ে এরা আমার পিছে দৌড় দিবে নাহ, পিস্তল দেখালে আমি দৌড় দেওয়ার চিন্তা মাথায় আনতাম নাহ। তারমানে ওদের কাছে আসলেই পিস্তল নাই। এখন ওদের কাছে একটা কিরিচ আছে... তাও ওটা ওদের থেকে যত দূরে রাখা আছে, আমার থেকেও ঠিক তত দূরেই রাখা আছে... বেক্কল নাকি? সেইম ডিস্টেন্সে অস্ত্র রাউখে ২ জন পকেটে হাত দিয়ে বিড়ি ফুঁকছে।

আমি আস্তে করে মোটরসাইকেলের উপর থেকে খবরের কাগজ সরিয়ে কিরিচটা হাতে নিলাম। মোটা জন একটা ধাক্কার মত খেলো আর ছোটজনকে রেখেই ভো দৌড় দিলো। ছোটজন অন্যদিকে তাকিয়ে ভাব নিচ্ছিল বলে ওর বুঝতে সময় লাগলো। ছোটজন আমার দিকে তাকিয়ে দেখে মোটা জন উধাও আর আমার হাতে কিরিচ। সেও একটা ঝাকুনির মত খেলো... ও কিছু বুঝার আগেই আমি ওর কলার ধরে ফেললাম।

আসে পাশে লোক বুঝতে পারছেনা এখানে কি হচ্ছে। তাকিয়ে দেখি মোটা জন দৌড় দিয়ে খুব একটা বেশী দূর যেতে পারেনি...থপ থপ দৌড়ানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে... একটু পর পর পিছে তাকাচ্ছে আর সমানে দৌড়িয়ে যাচ্ছে। আমি ছোটজনকে বললাম ‘তোর নামই কি মিলন?? উত্তর দে, নাইলে দিব এক কোপ’। ছোট জন হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে বলল, ‘আমার নাম টকন... আমি আইজ্জাই পরথম আইসি... আমাকে হে কইসে আমার কাম খালি দাড়ায়ে দাড়ায়ে সিরগেট ফুঁকা... আল্লার কীরা ভাই আমারে বিশ্বাস করেন...আমি আপনার লগে একটা কথা কইসি ভাই? আমি তো খালি দাড়ায়েই সিলাম। হেতে আমারে পলটি দিয়া দৌড় দিসে...মায়ের কীরা।’ আমি বললাম ‘তুই মোটরসাইকেল চালাইতে পারিস’? ও বলল ‘পারি’। আমি বললাম উঠ মোটরসাইকেলে, আমি তোর পিছনে বসবো... ঐ মোটা রে ধরবো... তুই যদি কথা মত না চালাস তাইলে এক কোপ দিয়া তোরে ফেলায়ে দিব...আজকে হয়তো তুই কোপ খাবি নয়তো মোটা কোপ খাবে। টকন সাথে সাথে চোখ মুছে লাফ দিয়ে মোটরসাইকেলে উঠে বসলো। আমি পিছনে কিরিচ উঁচা করে বসলাম...বললাম ‘চালা’। আসে পাশের উৎসুক মানুষ কিছুই বুঝতে পাড়ছে নাহ। হিন্দি সিনেমার মত টকন এর পিছনে বসে আমি মোটা জনকে দিলাম ধাওয়া। মোটা যখন দূর থেকে দেখল যে আমি কিরিচ উঠায়ে তার দিকে আসছি আর মোটরসাইকেল চালাচ্ছে তারই সাথি, সে সাথে সাথে ঝাকুনি দিয়ে স্পীড বাড়িয়ে মরন দৌড় দিলো। আমি বললাম “টকন হারামি জোড়ে চালা...জোড়ে...”

[NB: আরিফ ভাইয়ের ওয়েবসাইট (arifrhossain.com) ডাউন। আমি জানিনা উনার এই সাইটটা কে ম্যানেজ করে। এটা ডাউন রাখা উচিত হয়নি। উনার লেখাগুলা আমার কাছে অনেক ভাল লাগে। তাই ওয়েব আর্কাইভ থেকে লেখাগুলো কপি করে এখানে রেখে দিচ্ছি, যাতে করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম লেখাগুলো পড়তে পারে। Saturday, 24 November 2012]


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম