বছর খানিক আগের কথা... অফিসের কাজে বেইলি রোড গিয়েছি, যেহেতু অনেক ট্রাফিক ছিল, তাই গাড়ি প্রোজেক্ট থেকে একটু দূরে পার্ক করে হেঁটে যাই বাকি রাস্তা। তখন দুপুরপ্রায়...কাজ শেষ করে গাড়িতে উঠতে যাব ঠিক সেই সময় একজন গ্রাম্য চেহারার ফিটফাট লোক, সেন্ডেল পায়ে, এক হাতে কিছু বই আর এক হাতে ব্রিফকেস নিয়ে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া, সদরঘাট কোন দিকে?” আমি বললাম, ‘এখান থেকে যেকোনো রিক্সায় উঠে বলেন যে সদরঘাট যাব, ওরা পৌঁছে দিবে।’ উনি উত্তর দিলো, ‘রিক্সা না...রিক্সা না, আমাকে বলেন কোন দিকে, আমি হেঁটে যাব’।
‘হেঁটে যাবেন এতদূর? কেনও?’ আমি বললাম। উনি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো যে ‘সকাল ৬ টা থেকে উত্তরা থেকে হেঁটে এখানে এসেছি; সদরঘাটে লঞ্চ ধরে যাব বরিশাল... পকেটে টাকা নেই তাই হেঁটে যাব। আপনি খালি বলেন কোন দিকে হাটতে হবে তাইলেই হবে।’
আমি বললাম, ঘটনা কি বলেন তো খুলে। সে আমাকে জানালো যে সে একজন স্কুল শিক্ষক (সাথে থাকা তার আই.ডি কার্ড টাও দেখালও), বরিশাল থেকে ঢাকা এসেছে তার বন্ধুকে বিদায় দিতে এয়ারপোর্ট এ... বিদায় শেষে, উত্তরা এলাকায় তাকে ছিনতাইকারী ধরে... সব টাকা নিয়ে যায়। ভাগ্য ভাল তার বই এর ভিতরে ২০০ টাকা রাখা ছিল, ওটা নিতে পারেনি। লঞ্চ ভাড়া লাগবে ১৫০ টাকা আর লঞ্চে ভাত খেতে লাগবে ৫০ টাকা। বরিশাল একবার পৌঁছে গেলে আর সমস্যা নেই। ওখানে, ‘আমি রফিক মাস্টারকে’ সবাই চেনে। রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে যাব। এখন শুধু সদরঘাট যাওয়া পর্যন্তই একটু কষ্ট। তবে সমস্যা নেই, হাঁটাহাঁটি শরীরের জন্য ভাল। আপনি একটু আমাকে বলে দেন যে কোন দিকে হাটা দিতে হবে।
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। আমি উনাক জোর করে ৫০০ টাকা দিলাম, সুইস বেকারি থেকে কিছু নাস্তা পানি ও কিনে দিলাম। তারপর ভাংতি ভাড়া দিয়ে একটা রিক্সায় উঠিয়ে দিলাম সদরঘাটের উদ্দেশে। উনি আমায় দোয়া দিতে দিতে রিক্সায় উঠলেন।
উনার একটা গতি করতে পেরে আমার নিজের কাছেও খুব ভাল লাগছিলো। এই ঘটনাটা আমি গত বছর পর্যন্ত মনে রেখেছিলাম এবং যখনই আল্লাহ্র কাছে কিছু চাইতাম তখন এই রফিক মাস্টারের রেফারেন্স দিতাম... যেমন, ‘আমি তো অনেক মানুষের উপকার করেছি... ইয়ে, যেমন রফিক মাস্টার; সুতরাং আল্লাহ্ তুমি আমার এই কথাটা শুনবে না কেনও?’ :p
আল্লাহ্র কি কেরামতি, গতবছরে গুলশান ২ মার্কেটে হাঁটছি, ঠিক তখনই রফিক মাস্টার সাহেব উদয় হলেন। আমি ও উনাকে চিনতে পারিনি এবং উনি ও আমাকে চিনতে পারেনি। আমার কাছে এসে বলে, “ভাইয়া, মহাখালি বাস স্ট্যান্ড কোন দিকে?”। আমি অবাক হয়ে দেখি এই তো সেই রফিক মাস্টার। উনি আমাকে নির্লিপ্ত ভাবে বলতে থাকে ‘কোন দিকে? এই দিকে হাঁটলে হবে না ঐ দিকে হাঁটলে হবে?’
আমি বললাম, ভাই কাহিনী কি? উনি গড় গড় করে আগের কাহিনী টা বলল। এবার শুধু ‘বরিশালের’ জায়গায় বলল ‘পার্বতীপুর’ তার বাড়ি। বাকি সব একদম হুবুহু। নাম রফিক মাস্টার (উইথ আই.ডি), এয়ারপোর্ট কাহিনী, অতঃপর ছিনতাই, বই এর ভিতরে টাকা সব হুবুহু বলল।
রাগে আমার গা জ্বলছে। তাহলে এটা একধরনের প্রতারনা? কত বড় মাপের ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইলার সে, তা ভাবতেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিলো। আমি অনেক কষ্টে মাথা ঠাণ্ডা রাখলাম। ভাবলাম, ওকে যদি এখন পুলিশে দেই, লাভ নাই... একে যদি ধরে মাইর দেই, লাভ নাই কারন আশেপাশের মানুষ সবসময় সেন্টিমেন্টাল বিধায় অবহেলিত মানুষের পক্ষে থাকে আর যদি আমি কোনভাবে প্রমাণ না করতে পারি যে সে একটা প্রতারক, তাহলে বিশ্রী ব্যাপার হবে...
আমি গতবারের মত সুর মিলিয়ে গেলাম। বললাম, চলেন আমার সাথে... আমি মহাখালিই যাচ্ছিলাম, নামিয়ে দেই। বেচারা বলল, ‘না থাক, কষ্ট করবেন কেন আপনি, আমি হেঁটে হেঁটে চিনে নেব ঠিকই’। আমি হাত ধরে বললাম ‘স্যার, আপনি শিক্ষক মানুষ... আসেন, উঠেন আমার গাড়িতে’। মহাখালি গেলাম, ওর টাকা দিয়েই ওর বাসের টিকেট কাটলাম, তারপর হাত ধরে ওকে পার্বতীপুরের বাসে উঠিয়ে বসিয়ে দিলাম। নিচে নেমে, বাসের হেল্পারকে বললাম, এই নেন ১০০০ টাকা বখশিশ আপনাকে দিলাম। ঐ যে মানুষটাকে উঠিয়ে দিয়েছি উনার মাথায় সমস্যা আছে কিছু... আই মিন উনি মানসিক প্রতিবন্ধী। উনাকে রিসিভ করতে পার্বতীপুর ব্যাস স্ট্যান্ডে উনার আব্বা থাকবেন। আপনি খালি দেখবেন যেন উনি রাস্তায় বাস থেকে নেমে না পড়ে। বোঝাতে পেরেছি? হেল্পার সারা দিন ডিউটি করে হয়তো পায় ২০০ টাকা আর আমিই কিনা দিলাম ১০০০ টাকা বখশিশ। হেল্পার বলল, স্যার, আমার জান থাকতে উনি বাস থেকে পালাইতে পারব নাহ। আপনি নিশ্চিন্তে বাড়িত যান এখন... আপনার টেনশন অহন আমার টেনশন। আপনি খালি ৯ ঘণ্টা পড়ে খুজ নিয়েন যে বান্দা বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছাইয়াছে কিনা।
আমি রফিক মাস্টারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। বাড়ি ফিরতি একজন মানুষের চোখে এতো বিমর্ষতা থাকতে পারে তা বলে বোঝানো যাবে নাহ। হেঁটে আসতে আসতে দূর থেকে দেখলাম... রফিক মাস্টার বাস থেকে নামার চেষ্টা করছে আর হেল্পার ধাক্কায়ে উনাকে বাস থেকে নামতে দিচ্ছে নাহ। হেল্পারের উৎসাহ দেখে বুঝা গেল, আসলেই, তার জীবন থাকতে সে রফিক মাস্টারকে পার্বতীপুরের বাস স্ট্যান্ডের আগে কোনভাবেই নামতে দিবে নাহ।
[NB: মূল লেখক Arif R Hossain ভাই। উনার ওয়েবসাইট
http://arifrhossain.com ডাউন। তাই আমি ওয়েব আর্কাইভ থেকে কপি করে এখানে পোষ্ট করেছি, যাতে করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও লেখাগুলা পড়তে পারে। Saturday, 24 November 2012]
Pic: Collected
