ল্যান্ড ওউনার মানে জমির মালিক

৩/৪ বছর আগে আব্বার কাছে একটা গল্প শুনেছিলাম। গল্পটা এরকমএকদিন ওনার রুমে এক ভদ্রলোক আসেন। সুট-টাই পড়া মধ্য বয়সি এক ভদ্রলোক। এসেই সুন্দর ভাবে ইংরেজিতে ক্ষমা চেয়ে নেন বিনা এপয়েন্টমেন্টে দেখা করে আসার জন্য জন্য। উনার কাপড় চোপড় দেখেকথা বার্তা শুনে বোঝা যাচ্ছিলো যেউনার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড বেশ ভালই। সুন্দর ভাবে ভদ্রলোক জানালেন যেগুলশান এভেনিউ এর উপরে উনার ১ বিঘা একটা জমি আছে। উনি বিদেশে থাকেন,গত সপ্তাহে এসেছে ঢাকায় ... পরশু উনার ফ্লাইট। যাওয়ার আগে উনি তার জমিটা একজন ডেভেলোপারকে দিয়ে যেতে চাচ্ছেন। আব্বা নড়ে চড়ে বসলেন।

উনি বলতে থাকলেনস্টেইটসে লোক মুখে আপনার কোম্পানির অনেক নাম ডাক শুনেছি। আমি যেহেতু পরশুদিনই চলে যাচ্ছিতাই যাবার আগে ল্যান্ডটা আপনাকেই দিয়ে যেতে চাই। আমার ডিমান্ড বেশী নাহ... জাস্ট মার্কেট স্ট্যান্ডার্ড রেসিওসাইনিং এর সময় কোনও টাকা পয়সাও লাগবে নাহ। জমিটা যেহেতু আমার আব্বার সৃতিতাই আপনি ওটা সুন্দর করে করবেন... এর থেকে আর বেশী কিছু চাই নাহ। আব্বার বত্রিশ টা দাঁত বের হয়ে গেলো। এরকম ক্লায়েন্ট সব সময় পাওয়া যায় নাহ।

উনি আগামীকাল সকালেই এগ্রিমেন্ট করে ফেলতে চান। আব্বা বলল "অবশ্যই ভাই সাহেবঅবশ্যই... আপনার এই প্রোজেক্টে আমি ল্যান্ডমার্ক বানিয়ে ফেলব... ইওর ফোর-ফাদারস ল্যান্ড ইজ অন দাঁ রাইট হ্যান্ড... কালকে সকালে আসেনআমি সব পেপারস রেডি করে রাখব"। আব্বা কফি স্নাক্স খাওয়ালেনইউ.এস ইকোনমিবুশ-সাদ্দাম-তৈল ইস্যু নিয়ে আলাপচারিতাও করলেন। উনি হ্যান্ড শেইক করে বিদায় নিলেন...জেন্টেল ম্যান এগ্রিমেন্ট হয়ে গেলো। ভদ্রলোকের এখনই উঠতে হবে কারন তাকে শেরাটনে বন্ধুর বাচ্চার জন্মদিনের পার্টিতে যেতে হবেরাস্তায় ফিগট কিনতে হবে... তাই এখনই না উঠলে নয়। আব্বা লিফট পর্যন্ত ভদ্রলোকে এগিয়ে দিলেন।

ঠিক ৫ মিনিট পরে উনি আবার রুমে ঢুকলেন। আব্বা কে বললেন, ‘ভাইসাহেব আমার গাড়ি তো নিচে নেইমনেহয় ড্রাইভার ভুল বুঝেছে তাই আমাকে রেখেই চলে গেছে... এখন গাড়ির পেছনের সিটে আমার ওয়ালেট আর সেল ফোন রাখা ছিলড্রাইভারকে যে কল দিয়ে আবার ডাকবোতাও তো পাড়ছি নাহ... আর আমি ৫ বছর পর দেশে এসেছিআত্মীয়স্বজনের নাম্বার গুলোও মুখস্ত নেইসব নম্বর মোবাইলের ভিতরে। আব্বা বললেন, ‘নো প্রবলেম ভাই সাহেবআমার গাড়ি আপনাকে ড্রপ করে দিবে... আর ইয়ে যেহেতু ওয়ালেট সাথে নেই সুতরাং এই নেন কিছু টাকা... বার্থডে পার্টির গিফট তো কিনতে হবে আপনার... এগ্রিমেন্টের সময় না হয় ওটা আডজাস্ট করে নেব হা ...হা... হা...... শিট হেপেন্স হা...হা... ড্রাইভার মানেই অধৈর্যতা। ভাই সাহেব বেশী খারাপ লাগলে টাকা কালকে ফেরত দিয়ে দিলেই হবে। বলে আব্বা ১০ হাজার টাকা গুজে দিলেন। উনি অত্যন্ত লজ্জিত চেহারা করে টাকা নিলেন।

আব্বার গাড়ি উনাকে নিয়ে রওনা দিলো... ঠিক ১ ঘণ্টা পরে আমাদের ড্রাইভার আব্বা কে কল দিয়ে জানালো যে ঐ ভদ্রলোক গাড়িতে ওঠার ৫ মিনিটের মাথায় নেমে গেছেন আর বলেছেন অপেক্ষা করতে। ১ ঘণ্টা হয়ে গেলোউনি তো আর আসছে নাহ। আব্বা ড্রাইভারকে ধমক দিয়ে বললেন ভদ্রলোক মনেহয় গিফট কিনতে গিয়েছে... অপেক্ষা করো...এতো সহজে অধৈর্য হলে চলবে?’

৪ ঘণ্টা হয়ে গেলোউনি আর গাড়িতে ব্যাক করলেন নাহপরের দিনও এগ্রিমেন্ট সাইন করতে আসলেন নাহ... ফাইল ক্লউজড

এই ঘটনা নিয়ে বাসায় অনেক হাসাহাসি করলাম আমরা। আমরা আব্বা কে বললাম তুমি এতো বোকা কেনওআমরা হলে তো সাথে সাথেই বুঝে যেতাম উনি একটা টাউট। উনি যে জমির এড্রেস দিলোওটা তো সাথে সাথে চেক করা উচিত ছিল তোমার। আমাদের ডাটা বেইজে তো সব জমিজমার ডিটেইল থাকে... উনাকে বসিয়ে রেখেই ডাটা গুলো ক্রস চেক করে নিতে। আব্বা নিজেও লজ্জিত তার বোকামি নিয়ে তাই আর বেশী ঘাঁটালাম নাতবে আব্বা গত বছর পর্যন্তও বিশ্বাস করে ছিলেন যে উনি আসলেই ভদ্রলোককোনও একটা বিপদে পড়েছেন বলে আসতে পারেনিনা হলে অবশ্যই আসতেন পরের দিন অফিসেযার ব্যাবহার এতো অমায়িক সে আর যাই হোক এরকম টাউটবাজি করবে নাহ।

গত বছরের সময়ের কথাআমি অন্য একটা রিয়েলএস্টেট কোম্পানির মালিকের কাছে গিয়েছি একটা কাজে... উনার রুমে বসে বসে চা দিয়ে ভিজিয়ে বিস্কিট খাচ্ছিঠিক এমন সময় একজন ভদ্রলোক আসলেন উনার কাছে। অবিকল একই কথা বার্তা বলছেন। আমি চুপ করে চা খাচ্ছি আর শুনছি। রিয়েলএস্টেট কোম্পানির মালিক আমাকে সামনে বসিয়ে রেখেই একটা গুলশানের ১ বিঘা জমি মেনেজ করে ফেললেন। ভদ্রলোকের বার্থডে পার্টিতে যাবার তাড়া তাই কালকে সকালে এগ্রিমেন্ট সাইন করতে আসার কমিটমেন্ট দিয়ে বিদায় নিলেন... যাবার সময় আমার সাথেও হ্যান্ড শেইক করলেনআমার ডান হাতে বিস্কুট ছিল বলে উনি একটু অপেক্ষাও করলেন বিস্কুটটা শেষ করা পর্যন্ত... মুগ্ধ হবার মত ব্যবহার তার। আমি খালি আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ করছি যে মালিক অতি উসাহী হয়ে আমার সাথে উনার পরিচয়টা না করিয়ে দেন। উনি দিলেন ও নাহ...

মালিক হাসি মুখে উনাকে লিফটে উঠিয়ে দিয়ে আমার কাছে এসে বললেন, ‘আরিফ তুমি দেখি বিরাট ভাগ্য নিয়ে এসেছ আমার কাছে... দেখলে তোমার সামনেই একটা ল্যান্ড সাইন করে ফেললাম। আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললামঠিক ১০ মিনিটের মধ্যে যদি এই ভদ্রলোক আবার আপনার কাছে ফিরে এসে বলে, ‘তার গাড়ি নিচে নেইতাকে রেখে চলে গেছে’, তাহলে দয়া করে ঐ ভদ্রলোকে বলবেন যে আমি গাড়ি মেনেজ করছিআসুন আপনি আমার পাশের রুমে বসুন ৫ মিনিট। উনাকে পাশের রুমে বসিয়ে রেখে আমার কাছে আসবেনতারপর বাকি কথা।

আরিফ ইউ ফানি বয়...’ এরকম কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেনকথা শেষ হতে না হতেইইউ.এস সিটিজেন ভদ্রলোক "এক্সকিউজমি ভাইসাহেবআরেকবার একটু আসবো?" বলে রুমে ঢোকার অনুমতি চাইলেন।

[NB: আরিফ ভাইয়ের ওয়েবসাইট (arifrhossain.com) ডাউন। উনার লেখাগুলা আমার কাছে অনেক ভাল লাগে। তাই ওয়েব আর্কাইভ থেকে লেখাগুলো কপি করে এখানে রেখে দিচ্ছি, যাতে করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম লেখাগুলো পড়তে পারে। Wednesday, 07 November 2012]


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম