ঢাকায় আসার প্রায় সপ্তাহখানিক পরে হঠাৎ করে আমাদের এক পুরান ড্রাইভার যে কিনা আমাদের সাথে গত ৯ বছর ধরে ছিল (নাম হল শফিক...... ও এখন আবুধাবিতে আছে) আমার কাছে এসে বলে যে বলে যে ‘স্যার, দুবাইয়ের ভিসা পাইসি... আর দেশে থাকব নাহ... কালকেই আমার ফ্লাইট; আপনাকে সালাম করতে আসছি’। এই সময় আমার ছোটভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হতে আর প্রায় ৭/৮ দিনের মতো বাকি ছিল; এই সময় একজন বিশ্বস্ত ড্রাইভার চলে যাবে দেখে মনটা একটু খারাপ হল। আমি কড়া গলায় বললাম এখন যাওয়া হবে নাহ। সে উত্তর দিলো যে ‘জীনবাবা বলেছেন যে, কালকের মধ্যে না গেলে অমঙ্গল হবে’। আমি বললাম ‘জীন বাবা কি জিনিষ’? সে উত্তর দিলো যে উনার দোয়াতেই ভিসা পাইসি… আর উনি বলসে কালকের মধ্যে প্লেনে না উঠলে অমঙ্গল হবে। আমি আরও কড়া গলায় বললাম যে আপনার জীন বাবার আতা পাতা আমাকে দেন; আমি ক্রস চেক করবো। শফিক ড্রাইভার একটা কাগজে জীন বাবার মুরিদের নাম্বারটা লেখে দিয়ে, পায়ে ধরে সালাম করে চলে গেল। আমি বুঝলাম যে সে যেভাবেই হোক কালকের ফ্লাইট মিস করে তার অমঙ্গল করবে নাহ।
ঐ মুরিদের নাম্বার লেখা কাগজটা আমার অফিসের টেবিলের ড্রয়ারে পরে ছিল প্রায় এক মাস। হঠাৎ একদিন ড্রয়ার গোছাতে যেয়ে কাগজটা আবিস্কার করি। সেদিন মুড টাও ফুরফুরা ছিল; কি মনে করে কল দিলাম মুরিদ সাহেবকে। উনি ফোন টা ধরল… উনার আস্থানা হল শাহাজাদপুর (আমার অফিস, গুলশান থেকে ১০ মিনিটের দূরত্ব); যা বুঝতে পারলাম তা হল যে জীন বাবা প্রতি মঙ্গলবার আসরের ওয়াক্তে মানুষের সাথে দেখা করেন।
ভাগ্যক্রমে আমি মঙ্গলবার সকালেই কল টা দিয়েছিলাম। কোনও আগ পাছ না ভেবে আমি রওনা দিলাম জীন বাবার আস্থানায়। যেতে যেতে মনে মনে স্ক্রিপ্ট রেডি করছি যে কি বলব। যেহেতু শর্ট নোটিশে যাচ্ছি আবার কিছুটা এক্সাইটেড তাই আমার মেয়ের না খাওার প্রবলেমটা ছাড়া আর কোনও প্রবলেমের কথা মাথায় আসছিল নাহ; সুতরাং স্ক্রিপ্ট ঠিক করি যে, এই প্রবলেম নিয়েই কথা বলব।
আমি সব সময় খুব কেজুয়াল ড্রেসে থাকি সুতরাং আমাকে যেন খুব সাধারন দেখায় তার জন্য আর আমার ড্রেস চেইঞ্জ করতে হল না। শুধু ২ টা মোবাইলের মধ্যে সবচেয়ে কমদামী সেটটা নিয়ে গাড়ি থেকে নামি। আমি নিজে ড্রাইভ করে যাই শাহাজাদপুরের কাছে; ওখানে মেইন রোডে, একটা সুবিধাজনক জায়গায় গাড়ি পার্ক করে মুরিদ সাহেব কে কল দেই; সে ৫ মিনিটের মধ্যে এসে আমাকে রিশকা করে মেইন রোড থেকে একটু ভিতরে নিয়ে যায়। টাইমিং খুব সুন্দর ছিল কারন আমি ঠিক আসরের ওয়াক্তেই পৌঁছতে পেড়েছিলাম। শাহাজাদপুরের কাছেই কালাচাদপুরের একটা ৩ তলা বাসার সামনে আমি আর মুরিদ রিকশা থেকে নামি। আমাকে গেইটের বাইরে দাঁড় করিয়ে মুরিদসাহেব ভিতরে যান আর একটু পড়ে এসে বলেন যে হুজুর নামাজে বসেছেন; একটু অপেক্ষা করেন। গেইটের সামনে অপেক্ষা করার কোনও কিছু না থাকায় আমি গেইট থেকে বের হয়ে ঠিক সামনের একটা চা এর দোকানে বসি আর মুদির সাহেব কে বলি যে আমি এখানে আছি... আমাকে ফোন করলেই আমি গেইটের ভিতরে চলে আসবো। প্রায় আধাঘণ্টা বসে থাকি... একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে মুরিদকে ফোন করি। সে লাইন কেটে দিয়ে বাইরে আসে... এসে আমাকে বলে যে হুজুরের বুক কাঁপছে তাই উনি মাগরিবের আগে কারও সাথে দেখা করবেন নাহ। আমি বললাম যে ভাই আমি বরং আজ যাই। উনি বললেন ‘আচ্ছা যাইতে চাইলে যান গিয়া’। আমি চিন্তা করলাম এতো কষ্ট যখন করছি, আরেকটু করি; আর ২০ মিনিট র মধ্যেই তো মাগরিবের ওয়াক্তও হবে। দোকানে বসে বসে চা বিস্কুত খেয়ে , দোকানদারের সাথে গল্প গুজব করে ২০ মিনিট পাড় করলাম। আযান শোনা যাবার ঠিক ২ মিনিটের মধ্যে মুরিদ সাহেব বাইরে এসে আমাকে বললেন ‘আসেন ভিতরে আপনি’
ভিতরে গেলাম, আমাকে বাথরুম দেখিয়ে ওজু করতে বলা হল... ওজু করলাম; তারপর উনি আমাকে একটা ঘরে ঢোকার ইশারা দিলেন। আমি বিসমিল্লাহ্ বলে আল্লাহর নাম নিয়ে ঢুকে পড়লাম। ঢুকে দেখি দেওয়ালে হলুদ রং করা একটি রুম। পুরো রুমে মাদুর বেছান। আসে পাশে কিছু ইসলামিক বই পড়ে আছে যত্র তত্র। একজন আলখাল্লা আর চশমা পড়া এক মাঝ বয়সী ক্লিন শেইভড ভদ্রলোক জায়নামাজের উপর দাড়িয়ে আছে আর তার পাশে একটি খালি জায়নামাজ বিছানো আছে। আমাকে সুন্দর বাংলায় বললেন যে ‘আসেন নামাজ টা পড়ে নেই’। ৩ রাকাত ফরয পড়ার পরেও ২ রাকাত সুন্নত পড়লাম; যদিও আমি সাধারনত সুন্নত গুলো আলসেমির কারনে পড়ি নাহ। পুরো নামাজ আমি শেষ করলাম। আমাকে মাদুরে বসতে বলা হল। আমি আসতে করে বসতে যাব ঠিক তখনই আমাকে উনি বলল যে ‘আপনার ছেলেকে তার মায়ের বুকের দুধ টানা দুই বছর খাওাতে থাকেন… আর কোনও চিন্তা করা লাগবে নাহ, দেশ বিদেশের ডাক্তারদের কাছেও যাওয়া লাগবে নাহ। টানা ২ বছর খাওান শেষ হলে আমার কাছে আসবেন তার আগে নাহ। আপনি এখন যান; আমার বুকে ব্যাথা উঠেছে… যান’। আমি রীতিমতো এরকম বুকে ধাক্কা খেলাম। এতো অবাক আমি জীবনে হয়নি। আমি আস্তে করে বের হয়ে আসলাম রুম থেকে। পুরো মাথা চক্কর দিচ্ছে। মুরিদ কে বললাম আমি কি করবো এখন? কোনও টাকা পয়সা লাগবে? মুরিদ উত্তর দিলো যে হুজুর যা বলে দিয়েছে তা করেন। হুজুর টাকা পয়সা নেয় নাহ। আমি স্ট্রেইট ঐ বাসা থেকে বের হয়ে রিশকা নিয়ে গাড়ি পর্যন্ত যেয়ে বাসায় চলে আসলাম। কাউকে কিছু বললাম নাহ।
পরের দিন খালি হুজুরের কথা মাথায় ঘুরছে। কোনভাবেই হিসাব মিলাতে পাড়ছি নাহ। করলাম কি, আমার এক বন্ধু যে তখন RAB-1 এর উপ পরিচালক। ওকে সব ফোন করে সব কিছু খুলে বললাম; ও আমাকে বলল যে মুরিদ কে কল দিয়ে আবার এপয়েন্টমেন্ট নে... এবার আমি যাব তোর সাথে। থাবড়া দিয়ে হুজুরের জীন ভুত বাইর করবো... তুই খালি এপয়েন্টমেন্ট নে হারামজাদার!
..দিলাম মুরিদ সাহেবকে কল। উনি জানালো যে এই মঙ্গলবার উনি সৌদিআরব যাবেন তাই দেখা করতে পারবেন নাহ তবে খুব জরুরি হলে শুক্রবার বাদ জুম্মায় উনি স্পেসালি আমার সাথে দেখা করিয়ে দিবেন। আমি বললাম আমি শুক্রবার আসছি।
বন্ধু সময়মত সিভিল ড্রেসে রাস্তায় দাড়িয়ে ছিল। ওকে পিক করলাম। ও বলল যে আজকে তোর কথা বলা লাগবে নাহ, যা বলার আমি ই বলব। আগের মতই গাড়ি রেখে, রিশকা করে মুরিদ নিয়ে গেল। সামনের চায়ের দোকানে বসিয়ে মুরিদ বলল যে ২ জন কেনও? যার সমস্যা শুধু সেই যেতে পারবেন। ২ জন একসাথে যেতে পারবেন নাহ। আমি বললাম আমার বন্ধু যাবে ভিতরে; আমি এখানেই বসে থাকব।
এবার জোহরের ওয়াক্ত থেকে আসরের ওয়াক্ত পর্যন্ত বসিয়ে রাখল চা এর দোকানে। আমার বন্ধু অনেক ধৈর্য নিয়ে বসে থাকলো। ঠিক আসরের ওয়াক্তে মুরিদ এসে বন্ধুকে ভিতরে নিয়ে গেল। ১৫ মিনিট পড়ে যখন সে বের হয়ে আসলো আমার সামনে তখন ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো যে তার কেরামতি কাজে দেয়নি। সে আমার সামনে এসে কাপা গলায় বলল যে ‘আরিফ হাজার পাঁচেক টাকা থাকলে মুরিদ সাহেবের হাতে দে’... আমার কাছে ৩ হাজার ছিল, পুরো টাকাটাই আমি মুরিদ সাহেবের হাতে দিলাম। বন্ধু মুরিদের হাত ধরে বলল যে ভাই এই ৩ হাজার টাকায় একটা খাসি কিনে আমার নামে সদকা দিয়ে দেন; হুজুর তাই বলসে।
গাড়িতে উঠে সে মুখ খুলল। বলল যে, রুমে ঢোকার পড়ে হুজুরের সাথে নামাজ পড়া শেষ করার সাথে সাথেই সে কিছু বলার আগেই হুজুর ওকে বলে যে ‘আপনার গাড়ির বিজনেসে আগামী মাস থেকে প্রফিট আসা শুরু করবে... যদি এই মুহূর্তে একটা খাসি সদকা দেন’। এটা বলার পর হুজুর তাকে চলে যেতে বলে আর এও বলে যে ঠিক দুই মাস পড়ে আসেন প্রফিটের টাকায় মিষ্টি কিনে নিয়ে... তখন মিষ্টি খাব; এখন যান, আমার বুকে ব্যাথা উঠেছে… যান’
বন্ধুর সাইড বিজনেস হিসেবে গাড়ির বেবসা আছে তা আমি জানতাম। বুজনেস যে লসে চলছে তা আজকে সে আমাকে হুজুরের সাথে দেখা হবার আগেই বলে। কিন্তু এটা নিয়ে হুজুরের সাথে আলাপ করার কথা ছিল না তার। সে তার জমি জমা রিলেটেড একটা প্রবলেমের কথা বানিয়ে জুহুরকে বলবে এরকম কিছু একটা প্ল্যান করে রেখেছিল। কিন্তু প্রবলেমের কথা শুরু করার আগেই হুজুর কিভাবে জানি আসল প্রবলেম গুলো বুঝে যাচ্ছেন...ব্যাপারটা আসলেই ভৌতিক
ঠিক পরের দিন বন্ধু আমাকে কল দেয় দুপুরে; কল দিয়ে বলে যে তোর সাথে প্রথমদিন কি কি হয়েছিল পুরো বিষয়টা ডিটেইল বল আমাকে। সে পুরো বিষয়টা খুটিয়ে খুটিয়ে শুনে, তারপর বলে যে আচ্ছা আমি তকে একটু পর কল দিচ্ছি। ঠিক আধা ঘণ্টা পর সে কল দিয়ে বলে যে ‘আরিফ, এখনই হুজুরের সাথে এপয়েন্টমেন্ট ফিক্স কর... আমি মনে হয় এর ভাওতাভাজি ধরতে পাড়ছি... আমার সাথে RAB’এর কয়েকজন সিভিল ড্রেসে যাবে; মুরিদ বুঝবে না কিন্তু আমার লোকজন আমার আসে পাসেই থাকবে... যদি আমি যে জিনিষটা নিয়ে সন্দেহ করছি তা আজকেও মিলে যায় তাহলে আজকে হুজুরকে ধরে নিয়ে আসবো... এ এনে ওরে কি করি দেখ... তুই খালি এপয়েন্টমেন্ট ফিক্স কর... প্লিজ’
মুরিদ সাহেব কালকের জোহরের ওয়াক্তে এপয়েন্টমেন্ট দিলো... কিন্তু বন্ধু বলল ‘জোহরের ওয়াক্তে না’; আসরের ওয়াক্তে এপয়েন্টমেন্ট নে... কারন ও এমনিতেই ট্রিক্স করে আসরের ওয়াক্তে এপয়েন্টমেন্ট দিলেও মাগরিব পর্যন্ত বসিয়ে রাখবে... যেহেতু আসর মাগরিবের ব্রেক টা কম তাই তুই আসরের ওয়াক্তে এপয়েন্টমেন্ট নে...। মুরিদ সেদিন আসরের ওয়াক্তেই এপয়েন্টমেন্ট দিলো। সময় মতো রিশকা করে আমি আর বন্ধু গেলাম সেখানে... আমাদের আসে পাশে যে এর এতো RAB সদস্য সিভিল ড্রেসে ছিল তা আমি একদম শেষের দিকে বুঝতে পারি যখন মাগরিবের ওয়াক্তের কিছু পড়ে হুজুরকে পাঁজাকোলা করে RAB’এর গাড়িতে উঠানো হচ্ছিলো।
***(কি ভাবে হুজুরের ভাওতাভাজি ধরা পড়ল তা শনিবার বলব... খুব ইন্টারেস্টিং কাহিনী... হেভ এ গ্রেট ইউকএন্ড :p)***
[NB: আরিফ ভাইয়ের ওয়েবসাইট (arifrhossain.com) ডাউন। আমি জানিনা উনার এই সাইটটা কে ম্যানেজ করে। এটা ডাউন রাখা উচিত হয়নি। উনার লেখাগুলা আমার কাছে অনেক ভাল লাগে। তাই ওয়েব আর্কাইভ থেকে লেখাগুলো কপি করে এখানে রেখে দিচ্ছি, যাতে করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম লেখাগুলো পড়তে পারে। Saturday, 24 November 2012]
