৯৮ সালের প্রথম দিকের কথা... সবে মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। নটরডেম কলেজে ভর্তির হবার পর যেকোনো ছাত্র কে মিনিমাম ২ টা ক্লাবে নাম লেখাতে হয়। যতদূর মনে আছে, সেই সময় প্রায় ২৭ টা ক্লাব ছিল। খুব বেশী চিন্তা না করে ‘সাইন্স ক্লাব’ আর ‘চেস (দাবা) ক্লাব’এ নাম লেখালাম। প্রায়ই শুক্রবার করে সাইন্স ক্লাবের অনুষ্ঠান থাকতো আর তখন আমাদের প্রত্যেক মেম্বারকেকে ওয়েল ড্রেসড হয়ে আসতে হত। এরকম একদিন সাইন্স ক্লাবের একটা অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। টাই খুলতে খুলতে বাসায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এমন সময় সাইন্স ক্লাবের সেই সময়কার প্রেসিডেন্ট (সাধারনত সেকেন্ড ইয়ার থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হত) আমাকে ডেকে বলে যে ‘এই ছেলে তোমার খিদা লাগসে না? চলও আমার সাথে, কাচ্চি খাওয়াবো’।
প্রেসিডেন্টের এরকম দাওয়াত তো আর মুখের উপর না করে দেওয়া যায় নাহ। আমি দেখলাম আমার সাথে উনি আরও একজন ক্লাবের দেখতে সুন্দর করে নিউ মেম্বারকে নিলো। আমরা তিন জন রিক্সায় উঠলাম। রিক্সায় যেয়ে যেতে প্রেসিডেন্টে সাহেব বলল যে ‘শুনও ছেলেরা, আমরা এখন, একজনের বিয়ের দাওয়াত খেতে যাব। কার বিয়ের অনুষ্ঠান তা এই মুহূর্তে জানি নাহ তবে চিন্তার কিছু নাই, আমরা তো ডাকাতি করতে যাচ্ছি নাহ... আমরা যাচ্ছি একটা ভাল অনুষ্ঠানে শরিক হইতে’... যাব, খাওয়া দাওয়া করবো, কুশল বিনিময় করবো, তারপর পেট ভরে খেয়ে দোয়া দিতে দিতে বাসায় যাব’। আমার সাথে থাকা লাল টাই পড়া সুন্দরি ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো, ‘প্রেসিডেন্ট ভাইয়া, আমরা কি ফাও ফাও বিয়ের দাওয়াত খেতে যাচ্ছি?’ প্রেসিডেন্ট ভাইয়া এই প্রশ্নের উত্তর দাওয়াটাকে প্রয়োজনীয় না মনে করে উদাস মুখ করে পকেট থেকে সিগেরেট বের করলো।
লাল টাই পড়া সুন্দরি উনাকে আবার জিজ্ঞেস করলো ‘প্রেসিডেন্ট ভাইয়া, কোনও গিফট না নিয়ে গেলে তো প্রথমে ধরা খেয়ে যাব... আপনার পরিকল্পনা কি?’ প্রেসিডেন্ট ভাইয়া এ ধরনের প্রশ্ন শুনে এতোই অবাক হয়ে তাকাল যে তার অবাকের ঠেলায় সিগেরেট ধরাতে তার ২ টা দিয়াশলাইটের কাঠি খরচ হল। (আমিও মনে মনে ভাবলাম... গিফট যদি দিতেই হয় তাহলে এর কষ্ট করে ফাও ফাও খেতে যাব কেনও? গিফট না কিনে ঐ টাকা দিয়েই তো রিস্ক ফ্রি ভাবে দোকানে বসে কাচ্চি খাওয়া যায়... সুতরাং গিফট নিয়ে প্রশ্ন করাটা লাল টাইয়ের উচিতই হয় নায়... বোকা কোথাকার!)
রিকশায় যেতে যেতে প্রেসিডেন্ট ভাইয়া আমাদের তালীম দিচ্ছে... তালীমগুলো যতদূর এখন মনে পড়ে, এরকম ছিল:
- সাধারনত, খুব কাছের মানুষরা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিফট নিয়ে আসে নাহ... ওরা বিয়ের আগের দিনই পাত্র/পাত্রির বাসায় যেয়ে ওদের মা দের হাতে গয়না গাটি গিফট হিসেবে দিয়ে আসে... সুতরাং অনুষ্ঠানের দিনই যে গিফট দিতে হবে এই ধারনাটা ঠিক নয়। আমাদের ভাবসাব এমন হতে হবে যে আমরা সেই রকম আত্মীয়দেরই কেউ।
- অনুষ্ঠানে ঢুকতে ঢুকতেই বুঝে নিতে হবে যে এটা কি বিয়ের অনুষ্ঠান নাকি বৌভাতের অনুষ্ঠান। এটা বোঝার জন্য বিয়ের গাড়ি এবং বর কনের কাপড়ের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
- যদি এটা বিয়ের অনুষ্ঠান হয় তাহলে আমরা বর পক্ষ হয়ে যাব আর যদি বৌভাতের অনুষ্ঠান হয় তাহলে আমরা কনে পক্ষ
- গেইটে ঢোকার সময় দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতে হবে যে ‘এই যে শুনেন, ড্রাইভারদের কি খাবারের প্যাকেট দেয়া হবে নাকি ভিতরে আসতে বলব’? এটা বলে উত্তরের উপেক্ষা না করে সোজা ভিতরে হাটা দিতে হবে।
- ঢোকার সময় গেইটে ভিডিও ক্যামেরা অবশ্যই থাকবে। তখন বাম হাত চোখের উপর ধরে এমন হালকা বিরক্তিকর ভাব করতে হবে যে ‘যতসব ভিডিও মিডিও’র কারনেই আমি সচরাচর এইসব অনুষ্ঠানে আসি না...’ আর ডান হাত দিয়ে গেইটে দাঁড়ানো ওয়েল ড্রেসড ২/১ জন মুরুব্বির সাথে হাত মেলাতে হবে। ** তবে আমরা তিন জন একসাথে এটা করলে ধরা খেয়ে যাব। লাল টাই যেহেতু সুন্দরি মানুষ তাই আজকে সেই এটা করবে। আমি আর আরিফ পকেট এ হাত দিয়ে একে অপরের সাথে কথা বলতে বলতে গেইট দিয়ে ঢুকব।
- ঢোকার পড়ে প্রথম কাজ হল স্টেইজের কাছাকাছি দ্বিতীয় সারির সোফাগুলোতে বা চেয়ারগুলোতে যেয়ে বসা... তবে লাল টাই যদি চায় তাহলে স্টেইজের উঠে বর কনের সাথে ছবিও তুলে আসতে পারবে। লাল টাই বলল যে সে ছবি তুলতে আগ্রহি।
- যখন খাবার পরিবেশন করা হবে তখন যেহেতু আমরা স্টেইজের কাছাকাছিই বসে থাকব সুতরাং বর কনের লোকজনরাই আমাদের কে খাবার জন্য অনুরধ করবে। অনুরধ ছাড়া খাবার খেতে যাওয়া টা ঠিক হবে নাহ।
- খাবার টেবিলে আমরা তিন জন একটা করে চেয়ার গ্যাপ দিয়ে বসব।
- লাল টাই খাবার পরিবেশনের বেয়ারা কে বলবে যে ‘ভাই ২ তা পরিষ্কার কাটা-চামচ দিবেন প্লিজ’। আর এই কথাটা যতটা সম্ভব স্টাইল করে বলতে হবে।
- খাবার গ্লাস প্লেট পরিষ্কার আছে নাকি এটা নিয়ে আরিফ কথা তুলবে। যতই পরিষ্কার থাকুক অন্তত গ্লাস টা একবার বেয়ারা কে দিয়ে চেইঞ্জ করিয়ে নিতে হবে।
- খাবার আসলে সবার আগে পাশের মুরুব্বী কে তুলে দিতে হবে। এখন আমরা তিনজনই যদি একসাথে এই কাজ করি তাহলে ধরা খেয়ে যাব। আরিফ যেহেতু লম্বা আছে সেহেতু সে মুরুব্বীদের বোরহানির জগ এগিয়ে দিবে হাসি মুখে।
- খাবার সময় ভিডিও ক্যামেরা ছবি তুলতে আসলে তখন আর বাম হাত চোখের উপরে ধরবার দরকার নেই। বরহানির গ্লাস তা মুখের উপরে ধরলেই হবে।
- খাবার শেষ হয়ে গেলে অবশ্যই এই টেবিলের নিয়োজিত বেয়ারাকে (কায়দা করে আসে পাশের মানুষদের দেখিয়ে) বখশিশ দিতে হবে। যেহেতু লাল টাই এর চেহারা সুরতে বড়লোক বড়লোক ভাব আছে তাই এই কাজ টা সেই করবে। লাল টাই মাথা নাড়ালও এবং জানালো যে সে ১০০ টাকা পর্যন্ত বখশিশ দাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
- দাওয়াত ফিনিসিং কাজ টা হল দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ। খাওয়া দাওয়া শেষ করা মাত্রই বের হয়ে যাওয়া চলবে নাহ। কিছু সময়ের জন্য হলেও স্টেইজের কাছে আরাম করে বসে থাকতে হবে।
- বিপদ কখন আসবে বলা যায় নাহ তবে বিপদের জন্য সব সময় রেডি থাকতে হবে। উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগাতে হবে তখন। যেমন সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারে এই রিস্ক কম... কারন সহাগ-১ এর অথিতি সোহাগ-২ বা সোহাগ-৩ এ ভুল করে চলে আসতেই পারে… ব্যাপার না… মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। লাল টাই তখন বলল যে প্রেসিডেন্ট ভাইয়া, যদি ধরা পরেই যাই, তখন বুদ্ধি করে বললে হয়না যে ‘আমি নিরপক্ষ… আমি এই অনুষ্ঠানের বর কনে কে যে কাজি সাহেব বিয়ে পড়িয়েছেন তার ছেলে’। বিষয়টা সেনসিটিভ আর অতক্ষণে তো কাজি সাহেব বিয়ে পড়িয়ে বাসায় চলেই যাবেন… সুতরাং এই উত্তর তা কেমন ভাই? প্রেসিডেন্ট ভাইয়া লাল টাইয়ের উত্তর শুনে সেই রকম মুগ্ধ। এতদিন ধরে উনি ফাও বিয়ে খেয়ে আসছেন কিন্তু কোনদিন তার মাথায় এটা আসেনি। আমি ও মুগ্ধ লাল টাইয়ের উপস্থিত বুদ্ধি দেখে। আমরা ঠিক করলাম যে এটা হল আমাদের ট্রাম্প কার্ড… যদি কেউ কোনদিন জিজ্ঞেস করেই বসে, এটা হবে আমাদের ট্রাম্প উত্তর।
রিক্সা করে কাকরাইলের একটা কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে গেলাম। উনি বললেন যে ‘ফি আমানিল্লান... চল বাচ্চারা ঢুকে পড়ি’। সব কিছুই যে এতটা স্মুদ ভাবে হয়ে যাবে তা আগে বুঝিনি। ঐ বিয়ের অনুষ্ঠানে লাল টাই এমনই এক্টিং করে যে ঐ অনুষ্ঠানেই তার প্রেমে পড়ে যায় কনে পক্ষের এক মেয়ে। টানা ১৪ বছর তাদের প্রেম চলে। লাল টাই ৭ বছর পর বাংলাদেশে আসে, গতকাল সে কিভাবে যেন আমাকে খুজে বের করে...অফিসে আসে... আগামী কাল ৭ই জানুয়ারি শেরাটনের উইন্টার গার্ডেনে তাদের বিয়ে... লাল টাইয়ের সাথে প্রথম যেদিন আমার দেখা হয়েছিল সেদিনও ছিল ও লাকি বয়... আজ এতদিন পর আবার দেখা হল, এখনও সে লাকি বয় (লাকি কারন ওর ফেসবুক একাউন্ট নেই... থাকলে আজ ওকে আমি ‘মরন ট্যাগ’ করতাম ...হিহি)
[NB: আরিফ ভাইয়ের ওয়েবসাইট (arifrhossain.com) ডাউন। উনার লেখাগুলা আমার কাছে অনেক ভাল লাগে। তাই ওয়েব আর্কাইভ থেকে লেখাগুলো কপি করে এখানে রেখে দিচ্ছি, যাতে করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম লেখাগুলো পড়তে পারে। Saturday, 24 November 2012]
