চোরের মন পুলিশ পুলিশ

বছর দুই তিনেক আগের কথা হবে... গুলশান থানাতে গিয়েছি কোর্টের একটা ডকুমেন্ট সাবমিট করতে। কাগজটা অত্যন্ত জরুরি তাই নিজেরই যেতে হল। ওসি সাহেবকে কল দিয়েছিলাম, উনি জানালো যে উনি বাসা থেকে রওনা দিয়েছে, থানায় পৌঁছতে ১৫/২০ মিনিট লাগবে। রাস্তায় জ্যাম না থাকায় আমি একটু আগেই পৌঁছে যাই থানায়। যেহেতু ওসি সাহেব এখনও আসেনি, তাই ঠিক করলাম এখন থানার ভিতরে না যেয়ে, বাইরে নিজের গাড়িতেই বসে থাকি। থানার সামনে গাড়ি পার্ক করে বসে আছি আর ওসি সাহেবের থানায় আসার অপেক্ষা করছি।

(গাড়ির ‘মেইন ব্যাক মিরর’ যেটা কিনা সামনের দুই সিটের মাঝাখানে সিলিঙে এটাটচড থাকে, সেটাতে শখ করে অনেকেই অনেক কিছু ঝুলিয়ে রাখে... যেমন কেউ ঝুলিয়ে রাখে সিডি, কেউ ঝুলিয়ে রাখে তজবি বা কেউ কেউ সুতো দিয়ে বাধা কিছু একটা। গাড়ি কেনার পর থেকেই আমি ঐ স্থানে একটা বক্সিং গ্লভস ঝুলিয়ে রাখতাম ভাব মারার জন্য। বিয়ের পর বউ নিজ হাতে বক্সিং গ্লভসটি সরিয়ে ফেললো। এরকম বিধ্বংসী জিনিষ একজন ভদ্রলোকের গাড়িতে থাকতে পারে নাহ। আমি ও মেনে নিলাম। তার কয়েকদিন পর আরও একটি ভাবের আইডিয়া আসলো মাথায়। একটা সত্যিকারের ‘হ্যান্ড কাফ’ কিনলাম পলওয়েল মার্কেট থেকে এবং ওটা ঝুলিয়ে রাখলাম ওখানে। বউ যখন গাড়িতে উঠে নাহ তখন ঐ হ্যান্ড কাফটি ঝুলিয়ে রাখি।)

থানার সামনে গাড়িতে চুপ করে বসে আছি... ওসি সাহেব এখনও আসেনি। গাড়িতে একা একা বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছিলাম। সামনে যা পাচ্ছিলাম তা নিয়েই গুঁতাগুঁতি করছিলাম। হুট করে হ্যান্ড কাফটি চোখে পড়ল। চাবি দিয়ে হ্যান্ড কাফটি খুলে হাতে নিলাম। মনে মনে ভাবছি এই সহজ জিনিষটা কত সহজে মানুষকে আটকিয়ে রাখে; কিন্তু এটা হাতে পড়লে যে মুভমেন্ট করতে খুব কষ্ট হয় তা কিন্তু নাহ। কি মনে হল, নিজেই নিজের দুহাতে হ্যান্ড কাফ লাগালাম; দেখি তো আসলে মুভমেন্ট করতে সমস্যা হয় কিনা। হাতে পড়ে দেখলাম নাহ খুব একটা সমস্যা হয় নাহ... কান ও চুলকানো যায়, চশমাও হাত দিয়ে খোলা যায়। এক্সপেরিমেন্ট শেষ ...এখন, যখন চাবি দিয়ে খুলতে যাব হ্যান্ড কাফ তখন দেখি ‘ওমা, সব করা যাচ্ছে কিন্তু চাবি দিয়ে হ্যান্ড কাফ খোলা যাচ্ছে নাহ’।

ঠাণ্ডা মাথায় বসে আছি... দেখলাম হ্যান্ড কাফের মেকানিজম এমন ভাবেই করা থাকে যেন হাতে চাবি থাকলেও কেউ নিজের হ্যান্ড কাফ নিজে না খুলতে পারে। আশেপাশে লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে, কাউকে ডেকে খুলে দিতে বলা ঠিক হবে নাকি ভাবছি। থানার সামনের পার্ক করে থাকা গাড়ির ড্রাইভার একজনকে বলছে ‘ভাই এই নিন চাবি...এখন হ্যান্ড কাফটি খুলে দিন তো প্লিজ’...বিষয়টা খুব একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা না।

আমি হাত নিচু করে বসে আছি আর সমানে ঘামছি। ওসি সাহেব থানায় ঢুকেই আমার মোবাইলে কল দিলেন। আমি মোবাইলটি নিচে রেখেই ওটার স্পিকার অন করে ফোনটি রিসিভ করলাম। ওসি সাহেব জানালেন যে উনি আমার জন্যই থানায় এসেছেন ৫ মিনিটের জন্য। এখনই বের হয়ে যাবেন জরুরী কাজে... আমি কোথায়??

আমি বললাম ওসি সাহেব আমি আসছি... ৩/৪ মিনিট সময় দেন। মাথা কাজ করছে নাহ কি করা উচিত এখন। হ্যান্ড কাফ পড়া অবস্থাতেই মুডের উপর হেঁটে থানায় ঢুকে যেতে পারি... হোক না হাতে হ্যান্ড কাফ পরা, তাতে কি? আমি তো আর দোষের কিছু করিনি... কাউকে চাবি দেখিয়ে রিকোয়েস্ট করলেই শিওর খুলে দিবেন আমার হাত। আবার, প্ল্যান বি হিসেবে গাড়িতে বসে থেকেই, দুই হাত এক পকেটে ঢোকানর চেষ্টাও করেছি... বরই হাস্যকর উদ্যোগ এবং ফলাফল। একবার ভাবলাম বাসার কাউকে কল দিয়ে কি আসতে বলব এখানে? কিন্তু দিকে ওসি সাহেব তো ততোক্ষণে বের হয়ে যাবেন। এই মুহূর্তে স্বয়ং ওসি সাহেব ছাড়া আর কেউ আমাকে হেল্প করতে পারবে বলে মাথায় আসছিল না।

সাহস করে আমি ওসি সাহেবকেই কল দিলাম... ওসি সাহেব ফোন ধরেই উচ্চস্বরে বলে উঠে, ‘ভারি আজব মানুষতো আপনি... আসছেন না কেনও? ঠেকা কার? আপনার না আমার?’ আমি অত্যন্ত ভদ্রভাবে উনাকে বলি ‘ওসি আঙ্কেল, কিছু মনে করবেন নাহ আপনি কি একটু একা কষ্ট করে থানার বাইরে আসবেন প্লিজ? আমি গাড়িতে বসে আছি কিন্তু বের হতে পাড়ছি নাহ... আপনি আসলে বুঝতে পারবেন কেনও বের হতে পাড়ছি নাহ...একটু দয়া করে একা কষ্ট করে আসবেন? ‘ভারি আজব মানুষ তো আপনি’ বলে উনি ফোনটা মুখের উপর রেখে দিলেন। ওসি সাহেব যতই ঘুষ টুস খাউক না কেনও, উনাদের দেমাগ অল টাইম হাই থাকে। উনাকে রিকোয়েস্ট করাটাই মনে হচ্ছিলো আমার ভুল হয়েছে।

তাড়াহুড়ায় থাকার কারনেই হোক আর ওসি সাহেব বড় মনের মানুষ বলেই হোক, উনি থানা থেকে বের হয়ে আসলেন। আমার গাড়ি একটু সামনে রেখেছি তাই লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখতে পাচ্ছি উনি হেঁটে হেঁটে আসছেন... কিন্তু একা আসছেন নাহ...সাথে জুনিয়র ২/৩ জন পুলিশ। এখন ওসি সাহেব থানা থেকে হেঁটে বের হবেন আর সাথে ২/৩ জন জুনিয়র থাকবে নাহ, তা তো হয় নাহ

আমি বসে আছি হাত নিচু করে আর ব্যাক মিররে দেখছি ওসি সাহেব জোরে জোরে হেঁটে হেঁটে গাড়ির দিকে আসছেন তার ফোনে ধারনা হওয়া আজব মানুষটিকে দেখতে।

জীবনে এই প্রথম, চোর না হয়েও, ‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ’ ফিলিংসটা কি জিনিষ টের পেলাম...

(গল্প শেষ...এই গল্পেরও কোনও দ্বিতীয় পর্ব নেই)

NB: মূল লেখক Arif R Hossain ভাই। উনার ওয়েবসাইট  http://arifrhossain.com ডাউন। তাই আমি ওয়েব আর্কাইভ থেকে কপি করে এখানে পোষ্ট করেছি, যাতে করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও লেখাগুলা পড়তে পারে। Wednesday, 07 November 2012]


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম