কসাই ম্যানেজমেন্ট

কোরবানির ঈদ এর সময় ‘কসাই ম্যানেজমেন্ট’ একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এবার আব্বা হজে গিয়েছিল বিধায় এই ম্যানেজমেন্টের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়ে। অনেকেরই ফিক্সড কসাই থাকে যারা প্রতি ঈদ এ সেই বাসারই কাজ করে কিন্তু আমাদের বাসায় আজ পর্যন্ত কোনও কসাই টিকতে পারল নাহ। প্রতি ঈদ এই কসাই এর সাথে আব্বার বচসা, ‘মাংসের পিসের সাইজ কন্সটেন্ট থাকছে না কেনও?’... ‘আপনার ঐ লোক বসে আছে কেনও?’... ‘প্রফেশনাল কসাই হলে এক কোপেই এই পিস তা আলাদা করে ফেলতে পারতে...তোমার হাতের কাজ দেখে তো বোঝাই যায় যে তুমি ঈদ এর সময় ছাড়া বাকি সময় রিক্সার পাম্প ভোরার কাজ করো’। এরকম কথাবার্তা শোনার পর কোনও কসাই যে পুনরায় ঐ বাড়িতে আসবে তা ভাবার খুব একটা কারন নেই। আমি ও রাগারাগি করতাম যে ‘আব্বা তুমি এতো ছোটমোট বিষয় নিয়ে খিচ খিচ করনা তো... বিশ্রী লাগে’। কার কথা কে শুনে, উনি সমানে বলেই যেতেন, ‘ঐ কসাই তুমি এই কাঠের গুঁড়িটা কোথায় পাইস? এখানে আসার সময় রাস্তা থেকে টোকায়ে নিয়ে আসছ? ঐ উত্তর দাও না কেন? ঐ’

এই ঈদ এ যেহেতু আব্বা নেই তাই সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়ল। ঈদ এর এক সপ্তাহ আগে আমার লোকজনকে বললাম, যাও ঢাকার বেস্ট কসাই নিয়ে আসো... যত টাকা লাগে আমি দিব... নো হাঙ্কি পাঙ্কি এবার কসাই ইস্যু নিয়ে।

আমার ড্রাইভার দুই দিনের মধ্যে ঢাকা শহর খুজে বেস্ট কসাই কে আমার সামনে হাজির করলো। ড্রাইভার জানালো ‘নাম তার সাচ্চু কসাই... ওর চোখের দিকে তাকালেই নাকি গরু বুঝে যায় যে জবাইয়ের সময় নড়াচড়া করে লাভ নেই’... এই টাইপের কসাই সে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে উনাকে বললাম এডভান্স কত দিব? উনি বলল ‘দেন যত মনে চায়’। এই বেয়াদপ টা কসাই না হলে ওরে আমি ঐ মুহূর্তে রুম থেকে বের করে দিতাম, কিন্তু ঠেকা যেহেতু আমার তাই কিছু বললাম নাহ। যখন টাকা বুঝে তা গুনে নিচ্ছিল তখন দেখলাম উনার বাম হাতের ৩ টা আগুল কাঁটা। ওকে বিদায় করার পর আমার ড্রাইভারকে বললাম, ‘এর তো নিজেরই ৩ টা আঙ্গুল নাই... যে কিভাবে প্রফেশনাল হল?’ ড্রাইভার বলল, স্যার, ‘বড় বড় প্রফেশনাল গুন্ডা দের যেমন শরীরে কাজের ২/১ টা চিহ্ন থাকে তেমনি হের ও আসে’। আমি বললাম ‘হুম’

ঈদ এর দিন নামাজ পড়তে যাওয়ার আগেই দেখি সাচ্চু কসাই হাজির...গরুর ঠিক পাশে বসে গরু কে খাস খাওাচ্ছে আর মোবাইলে কার সাথে জানি উচ্চ গলায় ঝগড়া করছে। ওর কাছে যেয়ে বললাম ‘গুড টাইম ম্যানেজমেন্ট’... আপনার বাকি লোকজন কোথায়? সে জানালো তারা এখনই এসে পড়বে। আমি বললাম নামাজ শেষ করে আমি আর বাসায় যাব নাহ... একবারে গরু ছাগল গুলো জবাই দিয়ে কাজ শুরু করিয়ে দিয়ে তারপর উপরে যাব। আপনি সবকিছু রেডি করেন।

নামাজ পড়ে এসে দেখি সাচ্চু কসাই আর আমার ড্রাইভার পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে আর আমার ড্রাইভারের মোবাইল দিয়ে সাচ্চু কসাই কাকে যেন ফোন করার চেষ্টা করছে। আমি কাছে এসে বললাম ‘এ কি? চটাই মটাই কই? কিছুই তো বিছানো হয়নি এখনও।

ড্রাইভার আমার কাছে এসে চিন্তিত মুখে জানালো যে সাচ্চুর ভাগিনাকে টাকা হাতে দিয়ে গতকাল সকালে আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র কেনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আজ সকাল থেকে হে টাকা সমেত লাপাত্তা। আমি সাচ্চুর দিকে তাকিয়ে দেখি সে ফোনে কাকে জানি বলছে, ‘নটীর পুত তুই বরিশালে কি করস?’

আমি ২/১ জায়গাতে ফোন করে অন্য কসাইকে দিগুন টাকার লোভ দেখিয়ে আনার বন্দোবস্ত করলাম। সিকিউরিটি কে বললাম এই সাচ্চু না বাচ্চু এরে যেতে দিবেন নাহ... অন্য কসাইয়ের সাথে কাজ করে সে পয়সা উশুল করবে। সাচ্চু মাথা নেড়ে জানালো যে সে রাজি আছে।

৪০ মিনিটের মধ্যে অন্য টিম হাজির হয়ে গেলো। অন্য একটা গরুকে বেঁধে শুঁয়ায়ে ‘আল্লাহুয়াকবার’ বলার আগেই আমার ফোন পেয়ে দিগুন টাকার লোভে পুরো টিম এসে পড়েছে। নিজের বিপদ আগে সামলানো দরকার তাই কার গরু বাধা অবস্থায় শুয়ে আছে ওটা নিয়ে মাথা ঘামালাম নাহ। সাচ্চু ঐ কসাইকে বলল ‘এম্নে এম্নে শুয়ায়ে রাইখে আইসে পরসেন? পশুর প্রতি মায়া মহব্বত নাই আপনেদের?? মুখের সামনে কিছু ঘাস দিয়ে আসতেন... যাঊজ্ঞা, আহেন কাম শুরু করি’।

নতুন কসাই টিম এই সাচ্চু কে খুব একটা পছন্দ করছিল না কিন্তু সাচ্চু জান প্রান দিয়ে চেষ্টা করছিল কাজের মাধ্যমে তার পয়সা উশুল করতে।

কিছুক্ষণ দেখেই বুঝে গেলাম সাচ্চু মিয়া কসাইয়ের কাজ কিন্তু খারাপ জানে না...মাংসের পিস কেমন হতে হবে, সিনার হাড্ডি কিভাবে সাইজ করতে হবে, চামড়া কি ভাবে কাটলে বেশী দামে বিক্রি করা যাবে এসব বিষয়ে আসলেই সে দক্ষ। কিন্তু নতুন টিম কোনভাবেই ওকে মেনে নিতে পারছিল নাহ... হয়তো প্রফেশনাল জেলাসির কারনেই হবে। আমি সাচ্চুকে সাইডে ডাকিয়ে নিয়ে বললাম, আপনার কাজে হাত দেবার দরকার নেই, আপনি শুধু তদারকি করেন, তাহলেই হবে। সে খুশি হয়ে আমাকে জানালো যে ‘স্যার, আপনি ভাবিরে বলেন পিয়াজ কাঁটা শুরু করতে... একটু পর থেকেই মাংস আসা শুরু হইব... আমারে যখন দায়িত্ব দিসেন তখন আর আপনার চিন্তার অবকাশ নাই’।

আসলেই সাচ্চু সেই রকম ম্যানেজমেন্ট করে ২ টা গরু ৪ টা খাসি সময়মত শেষ করে ফেলে। এর মধ্যে কিছু ঘটনাও ঘটলো যেমন সে নতুন টিমের এক জুনিয়র পিচ্চিকে থাপ্পড় দিয়ে মাংসের মধ্যে ফেলে দিলো। কোনও মতে সাচ্চুকে থামানো হল; পড়ে শুনলাম ঐ পিচ্চি নাকি তার লুঙ্গির ভিতরে করে মাংস চুরি করছিল; এবং এর শাস্তি স্বরূপ ঐ পিচ্চিকে দিয়েই সে ৬ টা গরু-খাসির ভুঁড়ি পরিষ্কার করালও... আবার একজন মাংসের টুকরো একটু বড় করছিল বলে ওকে জোর করে ঐ কাচা মাংস খাওয়ায় দিতে উদ্যত হয়েছিল আর বলছিলও যে ‘মুখে নিয়ে দেখ এতো বড় মাংস মুখে আটে কি না... টুকটা ছোট কর হাতেম তাইয়ের পুত’। এরকম বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে গরু ছাগল বানানো শেষ হল।

আমি তার মেনেজারিয়াল প্রতিভা দেখে ওকে বাসায় ডেকে নিয়ে পেট ভরে দুপুরের পলাউ করমা খাওালাম, ১০০০ টাকা বখশিশ দিলাম আর তার বাসার জন্য ২ প্যাকেট মাংস দিলাম। উনি ঠিক যাবার আগে বলল, স্যার আমি বাড়ি যাব নাহ, কোথাও যাব নাহ... আমার নিজের ভাইগ্না আমারে যেভাবে অসম্মান করসে আর আপনি পর হয়ে আমাকে যেভাবে সম্মান করলেন, আমি আপনার সাথে সারা জীবন থাকব। এই নেন আপনার মাংসের পোটলা ফেরত।

আমি বললাম ‘এই ছেলে আপনাকে আমি কি চাকরি দিব? আমার এখানে তো আর মাসে মাসে গরু জবাই হয় নাহ...আর আপনি কসাই গিরি ছাড়া আর কিছু তো পারেন ও নাহ’। আপনাকে দিয়ে তো অন্য কোনও কাজ হবে নাহ। সে উত্তর দিলো, ‘হওাইলেই হইব’

যাই হোক, এই সাচ্চু মিয়া গত কোরবানির ঈদ থেকে আমার সিকিউরিটি কোম্পানির সুপার ভাইজার হিসেবে কাজ করছেন। দিনের বেলা আমার অফিসের ক্যান্টিনের কাঁচা বাজার করেন (যেখানে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ মানুষের দুপুরের রান্না হয়) আর রাতের বেলা সাইকেল দিয়ে আমার প্রোজেক্টে প্রোজেক্টে ঘুরেন। উনি যদি কোনও প্রোজেক্টের সিকিউরিটি গার্ডকে ঘুমন্ত অবস্থায় ধরতে পারেন তাহলে ঐ গার্ডের খবরই আছে।


*উপসংহারঃ সাধারন মানুষেরা আদতে নিষ্কর্মা নয়, নিষ্কর্মারাই তাদেরকে ব্যাবহার করতে জানে না... উপস। (আই মিন the mass people of Bangladesh are not useless, they are used-less)

[NB: আরিফ ভাইয়ের ওয়েবসাইট (arifrhossain.com) ডাউন। আমি জানিনা উনার এই সাইটটা কে ম্যানেজ করে। এটা ডাউন রাখা উচিত হয়নি। উনার লেখাগুলা আমার কাছে অনেক ভাল লাগে। তাই ওয়েব আর্কাইভ থেকে লেখাগুলো কপি করে এখানে রেখে দিচ্ছি, যাতে করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম লেখাগুলো পড়তে পারে। Sunday, 11 November 2012]


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম