ব্রেইন ড্রেইন

আমার এক কলেজ বন্ধু ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ করেই ইংল্যান্ডে চলে যায়। যাওয়ার আগে আমাকে বলে, ‘থাক তোরা এই বস্তা পচা দেশে, আমি গেলাম হলিউড’। আমি বললাম ‘তুই ইংল্যান্ডে হলিউড পেলি কোথায়?’ সে উত্তর দিলো, ‘হলিউড মানে শান-শওকত রে বুঝাইতেসি বেটা...শান-শওকত। তোদের মাথায় ঢুকবে না এই বিষয়... ফি আমানিল্লাহ’

২ বছর পড়ে দেশে আসে ৭ দিনের জন্য সে তার মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে। দেশ থেকে চলে যাবার ঠিক আগে এয়ারপোর্ট যাবার পথে আমাকে সে ফোন করে। তার মায়ের মৃত্যুর বিষয় নিয়েই ফোনে কথাবার্তা হল তাই ওর নিজের ব্যাপারে বেশী একটা কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি; শুধু একটু কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘তুই এখন কি করিস ওখানে?’ ওর উত্তর ছিল ‘আমি ইংল্যান্ডের একটা বড় আই.টি ফার্মে আছি... হার্ডওয়ার ডাউনলোড করি’। কথাবার্তা শেষ করে ফোন রাখার পর মনে হল, ‘হার্ডওয়ার ডাউনলোড’ জিনিষটা আবার কি? সারা জীবন শুনেছি ‘সফটওয়ার ডাউনলোড করে” কিন্তু ‘হার্ডওয়ার ডাউনলোড’ বিষয়টা মাথায় ঢুকলও নাহ। অতক্ষণে ও হয়তো এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে...তার উপর তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে তাই ওকে আর কল দিলাম নাহ। কিন্তু এই ‘হার্ডওয়ার ডাউনলোড’ টার্মটা ভুলতে পারছিলাম না।

তারও ঠিক ৫/৬ মাস পড়ে আমার ইংল্যান্ডে যাওয়া হয়... ওখানে যেয়েই ওর সাথে যোগাযোগ করি। ও খুব খুশি হয় আমি ইংল্যান্ডে এসেছি শুনে। ৩ ঘণ্টার মধ্যে সে আমার হোটেলে এসে হাজির। ওকে নিয়ে বের হলাম লন্ডন শহর ঘুরতে। কফি খেতে খেতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম “দোস্ত,‘হার্ডওয়ার ডাউনলোড’ বিষয়টা আমাকে একটু বুঝা তো”। ও ফিক করে হেসে দিয়ে বলে, ‘দোস্ত এখানে পিসি ওয়ার্ল্ড বলে একটা বড় আই.টি আউটলেট আছে... ওরা চায়না থেকে বিভিন্ন হার্ডওয়ার কিনে আনে... সারা রাত এই মালামাল গুলো আমি ঘাড়ে করে ট্রাক থেকে নামিয়ে শেলফে সাজিয়ে রাখি... হে হে’।তবে দোস্ত ইনকাম খারাপ নাহ... গতবার মায়ের কুলখানির জন্য ১ লাখ টাকা দিয়ে আসলাম বড় ভাইয়ের হাতে... ভালই চলে যাচ্ছে রে।

সারা দিন ওকে নিয়ে ঘুরলাম, খাওয়া দাওয়া করলাম তারপর ও চলে গেলো আমাকে হোটেলে ড্রপ করে। কেনও জানি খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো ওকে বলতে যে ‘দোস্ত আজকে রাতটা আমার সাথে থাক... সুখ দুঃখের গল্প করি’। কিন্তু বলা হল না প্লাস ওর চায়না থেকে কন্সাইন্টমেন্ট এসে গেছে... সারা রাত ডাউনলোড করতে হবে; তার বরই তাড়াহুড়া।

ঢাকার ফিরত আসার মাস ছয়েক পর একদিন ও আমাকে ফোন করে। ফোন করে খুব এক্সাইটেড হয়ে জানায় যে সে ‘দোস্ত আমি ভাল একটা অফার পেয়েছি... স্পেনের মাদ্রিদ শহরে একটা ইংলিশ চেইন ফাইভ স্টার হোটেলের রিসিপ্সন ডেস্কে কাজ পেয়েছি’। আমি প্রচণ্ড রকম খুশি হলাম... আমি বললাম দোস্ত তুই দেখি আলমোস্ট হলিউড টাইপ শান শওকতে থাকার মত চাকরি পেয়ে গেছিস… সাব্বাস রে সাব্বাস... ফোনের উল্টো দিকে ওর হাসি শুনতে শুনতে লাইনটা কেটে গেলো।

ফোন রেখে ভাবলাম, ওর এক্সেন্ট তো ইংলিশদের মত হয়নি এখনও প্লাস এখনও have has এ তালগোল পাকিয়ে ভুল ভাল ইংলিশ বলে তার উপর এতো তাড়াতাড়ি স্প্যানিশ শিখে কিভাবে ও এতো ভাল চাকরি পেল? যাই হোক, ছেলে যেহেতু ভাল তাই আল্লাহ্ ওর সাথে আছে এটা মনে করে খুব খুশিতে থাকলাম।

কয়েকদিন পরেই বন্ধুদের আড্ডায়, আমার অন্য এক বন্ধুর কাছে শুনলাম যে আমার ঐ বন্ধুটির ‘ফাইভ স্টার হোটেলের রিসিপ্সন ডেস্কে কাজ’ এর রহস্য। তার কাজ হল সারা দিন ‘ডোনাল্ড ডাক’ এর কস্টিউম পড়ে হোটেলের গেটের সামনে দাড়িয়ে থাকে... কোনও গেস্ট আসলে হাত পা নাড়িয়ে লাফ ঝাপ করে গেস্টদের হাত ধরে রিসিপ্সনের সামনে নিয়ে আসে... এতুকুই তার কাজ। বন্ধুদের আড্ডাতেই আমার মন প্রচণ্ড রকম খারাপ হয়ে গেলো। আমি একটু পড়ে আড্ডা থেকে অন্য কাজের বাহানা করে উঠে চলে আসি। ওদিকে বন্ধুরা এক একজন ওকে নকল করে কিভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে গেস্টদের নিয়ে আসে তা অভিনয় করে দেখাচ্ছিল। আড্ডা বেশ জমে উঠেছিল।

আমি শিওর আমাদের প্রত্যেকেরই এরকম ২/১ জন বন্ধু বান্ধব আছে যারা ভাল কিছু করার নেশায় মাঝপথে বিদেশ পাড়ি দিয়েছে... কেউ কেউ সেইম জায়গাতেই থেকে গেছে, কী কেউ একটু উপরে উঠে পেরেছে, আর কেউ কেউ এখনও উপরে উঠার ট্রাই করছে। আমাদের মধ্যে যারা এখান থেকে মোটামোটই স্টাব্লিশড হয়ে গিয়েছে হ্যাঁ তারা এখন অবশ্যই ভাল পজিশনে আছে কিন্তু যারা মাঝ পথে গিয়েছে তাদের অবস্থা আমি শিওর এখনও হলিউড টাইপ শান শওকতে থাকার মত অবস্থা হয়নি। এদের সংখ্যাও কিন্তু নেহাত কমও নাহ।

এই মাইগ্রেসন গুলোকে সমাজের ‘ব্রেইন ড্রেইন’ বলব না ‘পেইন ড্রেইন’ বলব তার উত্তর আমার জানা নেই। সে দেশে থাকলেও বা কি করত? দেশে থাকলে হয়তো মায়ের কূলখানি এতো বড় করে করতেও পারত নাহ... ওরা ভালই আছে ওখানে। দেশে এসে হতাশায় পড়ে থেকে একপর্যায়ে ড্রাগ নিতে বাধ্য হওয়ার থেকে ওখানে ডোনাল্ড ডাকের ড্রেস করে থাকা অনেক ভাল কাজ।

এখনও ডোনাল্ড ডাকের সাথে আমার কথা হয়… বলে যে ‘দেশে চলে আসবো দোস্ত’। আমি বলি, ‘যাই করিস দেশে আসিস নাহ’। সে এখনও আমার ইশারার অপেক্ষায় আছে যে কবে বলব যে ‘দোস্ত দেশে চলে আয় আর ও সাথে সাথে ডোনাল্ড ডাকের ড্রেস ম্যানেজারের মুখের উপর ছুড়ে দিয়ে দেশে এসে পড়বে’।

[NB: আরিফ ভাইয়ের ওয়েবসাইট (arifrhossain.com) ডাউন। আমি জানিনা উনার এই সাইটটা কে ম্যানেজ করে। এটা ডাউন রাখা উচিত হয়নি। উনার লেখাগুলা আমার কাছে অনেক ভাল লাগে। তাই ওয়েব আর্কাইভ থেকে লেখাগুলো কপি করে এখানে রেখে দিচ্ছি, যাতে করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম লেখাগুলো পড়তে পারে। - Thursday, 08 November 2012]




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম