সূরা কাফিরুনের সংক্ষিপ্ত তাফসীর

মিলেমিশে একে অন্যের ধর্ম পালনের পদ্ধতি। কিংবা মিলেমিশে একে অন্যের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান উদযাপনের পদ্ধতি। এগুলো নতুন কোন কৌশল নয়। রাসূল (সাঃ) মক্কায় তাওহীদের দাওয়াত দেয়া মাত্রই মক্কার কুরাইশগণ উনার উপর অমানষিক নির্যাতন শুরু করে। জুলুম নির্যাতন করেও যখন ইসলামের অগ্রযাত্রা রুখতে ব্যর্থ হয়। তখন তারা এক নতুন কৌশল আবিস্কার করে। আর সেটা হলো মিলেমিশে একে অন্যের ধর্ম পালন করার কৌশল। এটা ছিল অনেকটা বর্তমান সময়ের অনুরুপ তাওহীদ (আল্লাহর একত্ববাদ) ও কুফরীর মধ্যে একটা গোজামিলের ধর্মীয় আপোষ ও মীমাংসার প্রস্তাব। 

কুরাইশদের কাফের সম্প্রদায় তখন রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)কে আহবান করেঃ তিনি এক বছর তাদের মূর্তির পূজা করবেন। আর তারাও এক বছর আল্লাহর ইবাদত করবে (নাউজুবিল্লাহ)। 

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, কুরাইশদের কাফের সম্প্রদায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কে বললো : আমরা আপনাকে এত বেশী পরিমাণ ধন- সম্পদ দেবো যার ফলে আপনি মক্কার সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে যাবেন। যে মেয়েটিকে আপনে পছন্দ করবেন তার সাথে আপনার বিয়ে দিয়ে দেবো। আমরা আপনার পিছনে চলতে প্রস্তুত । আপনি শুধু আমাদের একটি কথা মেনে নেবেন — আমাদের উপাস্যদের বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকবেন। এ প্রস্তাবটি আপনার পছন্দ না হলে আমরা আরও একটি প্রস্তাব পেশ করছি। এ প্রস্তাবে আপনার লাভ এবং আমাদেরও লাভ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞেস করেন, সেটি কি? এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যদের ইবাদাত করবেন এবং আমরাও এক বছর আপনার উপাস্যকে ইবাদাত করবো। এর জবাবে মহান আল্লাহ সুরা কাফিরুন নাজিল করেন। 

ইবনে আব্বাস (রাঃ)এর অন্য একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কে বললো : “যদি আপনি আমাদের উপাস্য মুর্তিগুলোকে চুম্বন করেন তাহলে আমরা আপনার মাবুদের ইবাদাত করবো।” একথায় এই সূরাটি নাজিল হয়। (আবদ ইবনে হুমাইদ)

ওহাব ইবনে মুনাব্বাহ রেওয়ায়াত করেন, কুরাইশদের কাফের সম্প্রদায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কে বলে, যদি আপনি পছন্দ করেন তাহলে এই বছর আমরা আপনার দ্বীনে প্রবেশ করবো এবং এক বছর আপনি আমাদের ধর্ম পালন করবেন। (আবদ ইবনে হুমাইদ ও ইবনে আবী হাতেম)

এই অনৈতিক ও হাস্যকর প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)এর উপর পবিত্র এই সূরাটি নাজিল করেন। এবং আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যেন তাদের প্রস্তাব, তাদের আকিদা ও তাদের ধর্ম থেকে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করেন।

আল্লাহ্ তা’আলা নির্দেশ দিচ্ছেন তাঁর নবী (সাঃ)কে। তিনি যেন সুষ্পষ্ট ও প্রকাশ্য ভাবে কাফেরদের সামনে ঘোষণা করে দেন যে- আল্লাহকে বাদ দিয়ে প্রকাশ্যে বা গোপনে তারা যাদের ইবাদত করে থাকে তা থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। শির্কের সাথে মিশ্রিত ইবাদত আল্লাহর কাছে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে আল্লাহ্ তা’আলা দু’দলের মধ্যে এভাবে পার্থক্য করে দিয়েছেনঃ (لكم دينكم ولي دين) “তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য, আমার দ্বীন আমার জন্য।”

এই সূরায় যারা বিভিন্ন ধর্মের মাঝে দূরুত্ব কমিয়ে পরষ্পরের নিকটবর্তী হওয়ার কথা বলে। তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ইসলামই একমাত্র হক ধর্ম। তা ছাড়া অন্যান্য সকল ধর্ম বাতিল।  ইমাম শাফেয়ী (রঃ) (لكم دينكم ولي دين) “তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য, আমার দ্বীন আমার জন্য” - এ আয়াতটি থেকে এ দলিল নিয়েছেন যে, সকল কাফেরের ধর্ম একই। আসুন, এবার পুরো সূরাটি দেখে নেই:-

১। 

قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ

‘ক্কুল ইয়া- আইয়্যূহাল কা-ফিরূন।’

বলুন, হে কাফের দল! 

২। 

لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ

‘লা- ‘আবুদু মা- ‘তাবুদূন।’

আমি তার ইবাদত করি না, যার ইবাদত তোমরা কর।

৩। 

وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ

‘ওয়ালা- আন্তুম ‘আ-বিদূনা মা- ‘আবুদ।’

এবং তোমরাও তাঁর ইবাদতকারী নও, যাঁর ইবাদত আমি করি।

৪। 

وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ

‘ওয়ালা- আনা ‘আবিদূম্ মা- ‘আবাত্তুম।’

এবং আমি ইবাদতকারী নই তার, যার ইবাদত তোমরা করে থাক।

৫। 

وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ

‘ওয়ালা- আন্তুম ‘আ-বিদূনা মা- ‘আবুদ।’

এবং তোমরা তাঁর ইবাদতকারী নও, যাঁর ইবাদত আমি করি। 

৬। 

لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ

‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়া লিয়া দ্বীন।’

তোমাদের দ্বীন (শিরক) তোমাদের জন্য এবং আমার দ্বীন (ইসলাম) আমার জন্য।

এ সূরায় শিক্ষনীয়:-

১) এককভাবে একমাত্র আল্লাহর জন্য সমস্ত ইবাদতকে খালেছ বা একনিষ্ঠ করাকে বাধ্যতামূলক বলা হয়েছে। 

২) সব ধরনের শির্ক এবং শির্কের অনুসারীদের থেকে সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্ছেদ করাকে অতি অত্যাবশ্যক বলা হয়েছে। 

৩) যারা বিভিন্ন ধর্মের মাঝে দূরুত্ব কমিয়ে, পরষ্পরের ধর্মীয় উৎসব ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে সার্বজনীন দাবী করে। একে অন্যের ধর্মের নিকটবর্তী হওয়ার দাওয়াত দেয় তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কেননা আল্লাহ্ তা’আলা হক ও বাতিলের মাঝে সুষ্পষ্ট পার্থক্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং ইসলামই একমাত্র হক ধর্ম। তা ছাড়া অন্যান্য সকল ধর্ম বাতিল। হকের সাথে বাতিলের সামান্য মিশ্রণও যদি হয়, সেটা শির্ক। আর আল্লাহ সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন, শির্কের গুনাহ ছাড়া।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম